হজরত মাওলানা আহমদ লাট। জ্যোতির্ময় এক আদর্শ মানুষ। শ্যামল বর্ণের সাদাসিধে নিরহংকার এক আলেম। ভারতের গুজরাট প্রদেশের সুরাট এলাকার বাসিন্দা। তিনি তাবলিগ জামাতের আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা পরিষদের (মজলিসে শুরার) সদস্য। একজন ধর্মীয় নেতা এবং প্রচারক। টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা, পাকিস্তানে রায়বেন্ড ইজতেমাসহ বিশ্বের বহুদেশে অনুষ্ঠিত তাবলিগের ইজতেমাসমূহে প্রতি বছর তিনি বয়ান করে থাকেন। কিশোর বয়সে পরিবারের ইচ্ছা ছিল তাকে স্কুলে পড়ানোর, কিন্তু হজরত শায়খুল ইসলাম মাদানি (রহ.)-এর দোয়ার বরকতে তিনি মাদ্রাসায় পড়ে আলেম হন এবং বিশ্বব্যাপী ইসলাম প্রচারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। মাদ্রাসা থেকে পড়া শেষ হলে তার উস্তাদ হজরতজি মাওলানা ইলিয়াস (রহ.)-এর অন্যতম সহযোগী হজরত মাওলানা আলী মিয়া নদভী (রহ.) তাকে তাবলিগের কাজে নিয়োজিত করেন।
একবার টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানে মাওলানা আহমদ লাটের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য হাজির হন দেশের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন আলেম। তাদের সঙ্গে অনেক সময় পর্যন্ত খোলামেলা কথা বলেন। মনে হচ্ছিল ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে আলাপ করছেন। এক পর্যায়ে তিনি হজরত শায়খুল ইসলাম মাদানি (রহ.)-এর স্মৃতিচারণ করে বলেন, আমি হজরতের তিনটি কারামতের সাক্ষী।
এক. আমার বয়স যখন ৯ তখন হজরত মাদানি (রহ.) আমাদের এলাকায় সফরে আসেন। আমি বললাম, হজরত! আমার জন্য দোয়া করুন। হজরত বললেন, আল্লাহ তোমাকে ইলমে নাফে (উপকারী ইলম বা জ্ঞান) প্রদান করুক। আমার খান্দানের সবাই আমাকে স্কুলে পড়াতে চেয়েছিলেন। কিন্তু হজরত মাদানির দোয়ায় আমার ইলমে দ্বীন শিক্ষার পথ সুগম হয়।
দুই. আমাদের অঞ্চল থেকে অল্পসংখ্যক শিক্ষার্থী দারুল উলুম দেওবন্দে লেখাপড়া করতে আসত। কিন্তু হজরত মাদানির সফরের বরকতে এমন কোনো মহল্লা ছিল না, যে মহল্লা থেকে দলে দলে শিক্ষার্থী দারুল উলুম দেওবন্দে ইলম আহরণে আসেনি।
তিন. হজ ফরজ হওয়া সত্ত্বেও আমাদের অঞ্চলের খুব কম মানুষ হজ করত। তাদের কাছে এর গুরুত্ব ছিল না। কিন্তু হজরতের সফরের ফলে ওই বছরই হজের বিরাট কাফেলা তৈরি হয়ে যায়। এর মধ্যে বিরাট একটা অংশ যুবকদের ছিল।
মাওলানা আহমদ লাটের সঙ্গে দেখা করতে দিল্লির ফয়জে এলাহি মারকাজে একবার হাজির হলেন দারুল উলুম দেওবন্দের শুরা সদস্য মুফতি শফিক, সঙ্গে তার পরিচিত একজন আলেমও ছিলেন। গিয়ে দেখেন মাওলানা আহমদ লাট লখনৌর উদ্দেশে সফরে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সামনে রাখা একটি ব্যাগে কাপড় ভরছিলেন। কাপড়ের ওপরে একটি কিতাব রাখা ছিল, মাওলানা সাঈদ আহমদ খাঁন (রহ.)-এর ‘পত্রসমগ্র’। সফরে কিতাবের চেয়ে উত্তম সাথী আর কী হতে পারে? ব্যস্ততা সত্ত্বেও তিনি মুফতি সাহেবকে অত্যন্ত আবেগের সঙ্গে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, মনে হয় যেন বহুদিন থেকে তার অপেক্ষায় আছেন। খাদেমকে বললেন, খাওয়ার কিছু থাকলে নিয়ে এসো। মুফতি সাহেবের সঙ্গী খাদেমকে এই ভেবে ইশারায় নিষেধ করলেন যে, সফরের প্রাক্কালে নাস্তা করতে গেলে ঝামেলা হবে। কিন্তু মাওলানা আহমদ লাটের নজর এড়াতে পারলেন না। তিনি খাদেমকে জিজ্ঞেস করলেন, কী, নাস্তা আনতে বারণ করছে? খাদেম বলল, হ্যাঁ। এতে তিনি রাগ করে বললেন, আপনি যদি আমার আপ্যায়ন গ্রহণ না করেন তাহলে বাইরে চলে যান। কারণ কোনো ব্যক্তির সাক্ষাতে যাওয়ার পর যদি সেখানে কিছু পানাহার না করে তাহলে এটা মৃত ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়ার মতো হবে। বারবার তিনি কথাটি বলতে থাকেন।
একবার তিনি আমেরিকা সফরে ছিলেন। ওই দেশে তখন মারাত্মক এক মহামারীর প্রকোপ চলছিল। তিনি একটি আমল বাতলে দিলেন, যার মাধ্যমে বহু মানুষ আরোগ্য লাভ করে। আমলটি হলো প্রথমে সাত বার এই দরুদ শরিফ, ‘আল্লাহুম্মা সাল্লিআলা মুহাম্মাদিও ওয়াআলা আলি মুহাম্মাদ বিআদাদি কুল্লি দাইও ওয়া দাওয়া’, এর পর সাত বার সুরা ফাতেহা এবং সুরা ইখলাস সাত বার পড়বে। শেষে আবার সাত বার ওই দরুদ শরিফ পড়ে পানিতে দম করে পান করতে হবে। সুস্থ এবং রোগী সবাই পড়ে পানিতে দম করবে।
হজরত মাওলানা আহমদ লাট বলেন, তাবলিগ কোনো ফেরকা বা দল নয়, এটা নবীদের কাজ। এখানে কোনো ব্যক্তিবিশেষকে সামনে রেখে নয় বরং গোটা বিশ্বকে সামনে রেখে মেহনত করুন।