ভাগলো ব্রিটিশ সাতচল্লিশে
রয়ে গেল জালিম ও জুলুম
পাকিস্তানি হায়েনারা সব-
শুরু করল হালুম-হুলুম।
উর্দু হবে ‘রাষ্ট্রভাষা’ আটচল্লিশে
হুংকার ছাড়ে জিন্নাহ।
বাঙালি গর্জে বলে : জি না জি না!
৩৫ কোটির বেশি ‘বনি আদমে’র প্রাণের ভাষা বাংলা। ভাষার প্রতি ভালোবাসার পরিক্রমায় আসে প্রিয় স্বাধীনতা। ইসলাম মানুষের মুখের ভাষাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। পবিত্র কোরআনের সুরা রুম-২২, আর-রহমান-০১-০৪, দুখান-৫৮, শুরা-০৭, ইউসুফ-০২, মারইয়াম-৯৭, ত্বহা-১১৩, জুমার-২৮, নাহল-২৫, নুর-১৫, বালাদ-০৮-১০সহ বহু আয়াত তার প্রমাণ।
সমসাময়িক মানুষের মাতৃভাষায় বিভিন্ন আসমানি কিতাব অবতীর্ণ—‘আমি প্রত্যেক রাসুলকেই তার স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি তাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য।’ (সুরা : ইবরাহিম, আয়াত : ০৪) জাবুর ইউনানি, তাওরাত ইবরানি বা হিব্রু, ইঞ্জিল সুরিয়ানি বা আরেমীয় ভাষায় অবতীর্ণ, মূলত যা আরবিরই অপভ্রংশ। পবিত্র কোরআনের ভাষা আরবি। এমনকি হিব্রু ‘মু’ অর্থ পানি এবং ‘সা’ অর্থ কাঁটা শব্দের সন্ধিবদ্ধরূপ ‘মুসা’। গ্রিক ‘জসোয়া’র ইংরেজি ‘জেসাস’র আরবি ‘ইসা’ এবং বাংলারূপ ‘যিশু’!
মানব সৃষ্টির শুরুতেই ভাষার সৃষ্টি। আদি মানব-মানবী আরব ভূমিতে আবির্ভূত, তাঁদের ভাষা আরবি। আল্লামা জালালউদ্দিন সুয়ুতি (রহ.) বলেন, আরবি সর্বপ্রাচীন ও প্রথম ভাষা। (আল ইতকান, ১ম খণ্ড)
আদম (আ.)-কে জান্নাতে শব্দ ও ভাষাজ্ঞান দেওয়া হয়। পবিত্র কোরআনের ভাষায়—‘তিনি আদমকে সব কিছুর নাম শিক্ষা দিয়েছেন।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ৩১)
ইবনু আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, জান্নাতে আদম (আ.)-এর ভাষা ছিল আরবি। ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, নবী করিম (সা.) বলেন, ‘তোমরা তিন কারণে আরবিকে ভালোবাসো। কেননা আমি আরবি ভাষী, কোরআন আরবি ভাষায় অবতীর্ণ এবং জান্নাতিদের ভাষা হবে আরবি।’
‘ইন্দো-ইউরোপীয় প্যারেন্ট স্পিচ’ বলতে ‘সেমিটিক-প্যারেন্ট স্পিচ’ বা ‘সেমিটিক মূল ভাষা’ বোঝায়। নির্দিষ্টার্থে এ ভাষাটিই ‘আরবি’। এ সম্পর্কে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, আরবি, ফিনিসিয়ান, হিব্রু আরমায়িক, সুরিয়ানি প্রভৃতি বর্ণমালা মূল সামি বা সেমিটিক বর্ণমালা থেকে উদ্ভূত। লিপিবিদরা অকাট্যভাবে প্রমাণ করেছেন যে গ্রিক, লাতিন, ইংরেজি প্রভৃতি ইউরোপীয় বর্ণমালার উৎপত্তিও সেই মূল সামি বর্ণমালা থেকে। (সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ প্রথম খণ্ড)।
আদম-হাওয়ার ভাষা, প্রাচীনতম ভাষা আরবি। পৃথিবীর প্রাচীন অন্যান্য ভাষার মধ্যে আছে সংস্কৃত : ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ, গ্রিক : ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ, চীনা ভাষা : ১২৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ, হিব্রু : ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ, তামিল : ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষারও আছে হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্য।
বিশুদ্ধরূপে মাতৃভাষা শেখাতে প্রিয় নবী (সা.)-কে কোরাইশ বংশীয় রীতি অনুসারে পাঠিয়ে দেওয়া হয় হালিমা (রা.)-এর বেদুইন পরিবারে। ইসলাম প্রচারের সুবিধার জন্য প্রিয় নবী (সা.)-এর উৎসাহে স্বভাবকবি জায়েদ (রা.) সমসাময়িক সব ভাষায় দ্রুত সমান দক্ষতা অর্জন করেন। অথচ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ইসলামের শাশ্বত চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করে। আল-মাহমুদের কবিতা :
বায়ান্নর একুশ তারিখ দুপুর বেলার ওয়াক্ত
বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি কোথায়—বরকতেরই রক্ত।
রক্তাক্ত পথে যারা পেলেন ‘অমরত্ব’ ইসলাম তাঁদের উচ্চ মর্যাদার সুসংবাদ শোনায়—“যারা আল্লাহর পথে মারা যায় তোমরা তাদের মৃত বোলো না বরং তারা ‘চিরঞ্জীব’…।” (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৫৪)
‘একুশ’ জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের হাহাকার :
…দেশের সোনার ছেলে খুন করে রোখে মানুষের দাবি…
আমার শহীদ ভাইয়ের আত্মা ডাকে
জাগো মানুষের সুপ্ত শক্তি হাটে মাঠে ঘাটে বাটে
দারুণ ক্রোধের আগুনে আবার জ্বালবো ফেব্রুয়ারি
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।’
(আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী)
বাংলাদেশসহ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মনিপুর, বিহার, ওড়িশা ও মিয়ানমারের আরাকান জনগোষ্ঠী কথা বলে বাংলায়। বাংলা ভারতের আসাম, আফ্রিকার সিয়েরা লিয়নের দ্বিতীয় সরকারি ভাষা। আমাদের প্রাণের ভাষাকে টিকিয়ে রাখা ও সর্বস্তরে ব্যবহার সময়ের দাবি।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, কাপাসিয়া, গাজীপুর