বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আ.হ.ম মুস্তফা কামাল। বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে নতুন অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার এই বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন তিনি। এতে রেকর্ড ২ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি পূরণ করতে হবে দেশি-বিদেশি ঋণ থেকে। ‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন’- শিরোনামে অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় নানামুখী চ্যালেঞ্জের কথা বলেছেন। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নানামুখী পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারি ব্যয় সংকোচন, চাহিদার প্রবৃদ্ধি হ্রাসের পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। বাজেট বক্তৃতায় তিনি বলেছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের মূল কৌশল হবে বিদ্যমান চাহিদার প্রবৃদ্ধি কমিয়ে সরবরাহ বাড়ানো। প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৫.৬ শতাংশে ধরে রাখার লক্ষ্য ধরা হয়েছে। যদিও বিদ্যমান মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তুলনা করে অর্থনীতিবিদরা বলছেন মূল্যস্ফীতির এই লক্ষ্য অর্জন করতে হলে সরকারকে কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। ব্যাপক মূল্যস্ফীতির কারণে জনজীবন চাপে পড়লেও করমুক্ত আয়সীমা আগের মতো তিন লাখ টাকাই রাখা হয়েছে।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে চাপে থাকা সাধারণ মানুষের জন্য বাজেটে বড় কোনো সুখবর নেই। বরং অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারের দাম ধাপে ধাপে বাড়ানোর কথা বলেছেন। এসব সেবা ও পণ্যে মূল্যবৃদ্ধি হলে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ নতুন করে চাপে পড়বে। এছাড়া মূল্যবৃদ্ধির জন্য সাধারণ মানুষ যে অসহনীয় পরিস্থিতিতে রয়েছে তা থেকে উত্তরণেও তেমন কোনো নির্দেশনা নেই প্রস্তাবিত বাজেটে। চাহিদার প্রবৃদ্ধি কমিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অর্থমন্ত্রী যে কথা বলেছেন এটি বাস্তবসম্মত নয় বলে মনে করা হচ্ছে। বাজেট ঘাটতি পূরণে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে যে রেকর্ড পরিমাণ ঋণ নেয়ার কথা বলা হয়েছে এতে বেসরকারি খাতের ওপর চাপ বাড়বে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন।
নানা চ্যালেঞ্জের বাজেটে অর্থমন্ত্রী সব কর্মজীবীকে অবশ্য আশার বাণী শুনিয়েছেন। বাজেটে সার্বজনীন পেনশন সুবিধা চালুর পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন তিনি। এছাড়া বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ কর দিয়ে দেশে ফিরিয়ে আনার সুযোগ দেয়ার কথাও বলা হয়েছে বাজেট প্রস্তাবে। যদিও এই অর্থের বিষয়ে যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে তা নিয়ে দ্বিমত করেছেন অর্থনীতিবিদরা। অর্থমন্ত্রীর বাজেট পেশের পর সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছে, যে লক্ষ্যে বাজেটে পদক্ষেপগুলো নেয়া হয়েছে সেগুলো অপরিপূর্ণ। বাজেটে অন্তত ৭টি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলেও মনে করে সংস্থাটি।
বৃহস্পতিবার উপস্থাপিত বাজেট বাংলাদেশের ৫১তম এবং অর্থমন্ত্রী আ.হ.ম মুস্তফা কামালের চতুর্থ বাজেট। নতুন অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের (৫ লাখ ৯৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা) চেয়ে ১৪.২৪ শতাংশ বেশি। টাকার ওই অংক বাংলাদেশের মোট জিডিপি’র ১৫.২৩ শতাংশের সমান। বিদায়ী অর্থবছরে বাজেটের আকার ছিল ২০২০-২১ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটের ১২ শতাংশ বেশি এবং জিডিপি’র ১৭.৪ শতাংশের সমান।
বৃহস্পতিবার বিকালে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে জাতীয় সংসদে প্রায় দুই ঘণ্টা সময়ে উপস্থাপিত বাজেটের বিভিন্ন দিক ভিজ্যুয়ালি উপস্থাপন করা হয়। এর আগে সংসদ ভবনে মন্ত্রিসভার বিশেষ সভায় বাজেট অনুমোদনের পর ওই প্রস্তাবে সই করেন প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ।
অর্থমন্ত্রী পৌনে সাত লাখ কোটি টাকার যে বাজেট প্রস্তাব করেছেন তার ১৫.৭ শতাংশ যোগাড় করতে হবে ব্যাংক ঋণ থেকে। বাজেটের ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব খাত থেকে যোগান দেয়ার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। চলতি বাজেটের চেয়ে রাজস্ব খাতে বাড়তি ১২ শতাংশের মতো আয় করতে হবে। বিদ্যমান ব্যবস্থায় এই আয় বাড়ানোকে বড় চ্যালেঞ্জ মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি থাকবে ২ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এই ঘাটতি মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় ৫.৫ শতাংশ। করোনা মহামারির আগে প্রায় এক যুগ এই ঘাটতির পরিমাণ জিডিপি’র ৫ শতাংশের মধ্যে ছিল। মহামারি শুরুর পর থেকে বাড়তি টাকা যোগানোর চাপে গত দুই বছরের বাজেটে ঘাটতি জিডিপি’র ৬ শতাংশ ছাড়ায়। প্রস্তাবিত বাজেটে অভ্যন্তরীণ খাতের মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে রেকর্ড ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছে। যা মোট ব্যয়ের ১৫.৭ শতাংশ। এ ছাড়া সঞ্চয়পত্র থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাত থেকে আরও ৫ হাজার কোটি টাকা নেয়ার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। বাজেটে সম্ভাব্য বৈদেশিক অনুদান পাওয়ার পরিমাণ ধরা হয়েছে সোয়া ৩ হাজার কোটি টাকা। এবার দেশি-বিদেশি ঋণের জন্য ৮০ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা খরচ হবে বলে বাজেট প্রস্তাবে বলা হয়েছে। যা মোট অনুন্নয়ন ব্যয়ের প্রায় ২০ শতাংশ।
বাজেটে অর্থায়নের উৎস হিসেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড নিয়ন্ত্রিত কর থেকে ৫৪.৬ শতাংশ, অভ্যন্তরীণ ঋণ থেকে ২১.৬ শতাংশ, বৈদেশিক ঋণ থেকে ১৪.১ শতাংশ, কর ব্যতিত প্রাপ্তি থেকে ৬.৬ শতাংশ আহরণের কথা বলা হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড নিয়ন্ত্রিত করের মধ্যে মূল্য সংযোজন কর থেকে ৩৮.২ শতাংশ, আয়কর থেকে ৩২.৭ শতাংশ, সম্পূরক শুল্ক থেকে ১৫.৮ শতাংশ, আমদানি শুল্ক থেকে ১১.৯ শতাংশ আয় করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে বাজেটে।
নতুন অর্থবছরের বাজেটে বেশ কিছু পণ্য ও সেবার ওপর কর ও শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। কমানো হয়েছে কিছু পণ্যের। এর মধ্যে মুড়ি, চিনি আর গমের মতো খাদ্যপণ্যের উপর থেকে কর ও শুল্ক কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। করোনাভাইরাসের পরীক্ষা ও সুরক্ষা সরঞ্জামের ওপর থেকে তুলে নেয়া হয়েছে শুল্ক কর মওকুফের সুবিধা। তথ্যপ্রযুক্তি ও কম্পিউটার শিল্পের বিকাশের লক্ষ্যে মোবাইল ফোনের ব্যাটারি, চার্জার ও ইন্টারেকটিভ ডিসপ্লে-এর স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি প্রদানের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। তাই এসব পণ্যের দাম কমতে পারে। রডের ব্যবসায়ী পর্যায়ের ভ্যাট প্রতি মে. টন ৫০০ টাকার পরিবর্তে ২০০ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। তাই রডের দাম কিছুটা কমতে পারে। পরিবেশবাদীদের আপত্তি থাকলেও এবার বাজেটে পলিথিন ও প্লাস্টিক ব্যাগ, মোড়ক সামগ্রীর ওপর বিদ্যমান ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক অব্যাহতি প্রদানের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। এতে পলিথিন ও প্লাস্টিক ব্যাগের দাম কমতে পারে। নিবন্ধিত হাঁস-মুরগির খামারের ক্ষেত্রে যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ আমদানির আগাম কর অব্যাহতির প্রস্তাব করা হয়েছে। গোখাদ্যের উৎপাদন ব্যয় কমাতে সুগারকেইন মোলাসেস’র ওপর আমদানি শুল্ক ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে এই শিল্পের সুবিধা হতে পারে।
প্রস্তাবিত বাজেটে মোবাইল টেলিফোন সেটের ব্যবসায়ী পর্যায়ে বিদ্যমান ৫ শতাংশ মূসক অব্যাহতি প্রত্যাহার করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। এতে এই পণ্যের দাম বাড়বে। কোভিড-১৯ এর টেস্ট কিট, প্রটেকটিভ গার্মেন্টস, ফেইস শিল্ড, মেডিকেল প্রটেকটিভ গিয়ার, প্রটেকটিভ চশমা এবং মাস্ক এর উৎপাদন ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি প্রত্যাহারের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। এতে করোনা সুরক্ষা সামগ্রীর দাম বাড়বে। তামাকজাত পণ্যের ব্যবহার কমানো ও রাজস্ব আয় বাড়ানোর কথা বলে বাজেটে সিগারেটের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী।