Monday, December 4, 2023
spot_img
Homeধর্মইসলামে সন্তান প্রতিপালনে মায়ের অধিকার

ইসলামে সন্তান প্রতিপালনে মায়ের অধিকার

সন্তানের প্রথম ও প্রধান অভিভাবক তার পিতা। ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে শিশু পিতৃপরিচয়ে বড় হবে এবং সন্তানের প্রতিপালনের যাবতীয় দায়-দায়িত্ব পিতা বহন করবে। কিন্তু পিতার অনুপস্থিতে পরিবারের আপন আত্মীয়রা ক্রমন্বয়ে অভিভাবকত্ব লাভ করবে। এ ক্ষেত্রে কিছু বিষয়ে মা কোনো ধরনের আইনি প্রক্রিয়া ছাড়াই অগ্রাধিকার লাভ করবে। আর কিছু ক্ষেত্রে অভিভাবকত্ব লাভে তাকে আইনি প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে হবে।

সর্বাবস্থায় ইনসাফ কাম্য : সন্তান প্রতিপালনে ইসলাম সর্বাবস্থায় ন্যায় ও ইনসাফ রক্ষার নির্দেশ দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে পিতা, মাতা ও সন্তান সবাই ন্যায়ানুগ আচরণ লাভের দাবি রাখে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যে স্তন্য পানকাল পূর্ণ করতে চায় তার জন্য মায়েরা তাদের সন্তানদের পূর্ণ দুই বছর স্তন্য পান করাবে। পিতার দায়িত্ব যথাবিধি তাদের ভরণপোষণ করা। কাউকে তার সাধ্যাতীত কার্যভার দেওয়া হয় না। কোনো মাকে তার সন্তানের জন্য এবং কোনো পিতাকে তাঁর সন্তানের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত করা হবে না। আর উত্তরাধিকারীরও অনুরূপ কর্তব্য।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৩৩)

মায়ের অগ্রাধিকার : সন্তানের ব্যাপারে মায়ের অগ্রাধিকার রয়েছে। কেননা সন্তানের জন্য মায়ের আত্মত্যাগ অপরিমেয়। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে মায়ের অগ্রাধিকারের ব্যাপারেও সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আমি মানুষকে তার মাতা-পিতার প্রতি সদয় ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছি। তার জননী তাকে গর্ভে ধারণ করে কষ্টের সঙ্গে এবং প্রসব করে কষ্টের সঙ্গে।’ (সুরা : আহকাফ, আয়াত : ১৫)

তাফসিরবিদরা বলেন, উল্লিখিত আয়াতে আল্লাহ মায়ের কষ্টের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। এতে বোঝা যায়, মা সম্মান-মর্যাদা ও মূল্যায়নে অগ্রাধিকার লাভ করবেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-ও বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এক লোক রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল : হে আল্লাহর রাসুল, আমার নিকট কে উত্তম ব্যবহার পাওয়ার অধিক হকদার? তিনি বললেন, তোমার মা। লোকটি বলল, অতঃপর কে? নবী (সা.) বললেন, তোমার মা। সে বলল, অতঃপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সে বলল, অতঃপর কে? তিনি বললেন, অতঃপর তোমার বাবা।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৯৭১)

অভিভাবকত্বের প্রকার ও বিধান

ইসলামী শরিয়তের আলোকে নাবালক শিশুর অভিভাবকত্ব তিন প্রকার। তা হলো—ক. প্রতিপালনের অভিভাবকত্ব, খ. শিশুর জীবনসংক্রান্ত অভিভাবকত্ব, গ. শিশুর সম্পদ বিষয়ক অভিভাবকত্ব।

ক. প্রতিপালনে মায়ের অগ্রাধিকার : শিশু ছেলে হোক বা মেয়ে তাঁর প্রতিপালনে মায়ের অগ্রাধিকার প্রমাণিত। আর মায়ের অনুপস্থিতিতে শিশুর নিকটাত্মীয়দের মধ্যে নারীরা প্রতিপালনের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবে। যেমন দাদি, নানি, ফুফু, খালা প্রমুখ। তবে সন্তানের প্রতিপালনের দায়িত্ব গ্রহণে মাকে নিম্নোক্ত শর্তগুলো পূরণ করতে হবে। তা হলো—

১.  মুকাল্লাফ (যার ওপর শরিয়তের বিধান প্রযোজ্য) হওয়া।

২.  স্বাধীন হওয়া।

৩.  ন্যায়পরায়ণ হওয়া।

৪.  শিশু মুসলিম হলে বা তাঁর পিতা মুসলিম হলে মুসলিম হওয়া।

৫.  শিশুর অনাত্মীয় কোনো পুরুষকে বিয়ে না করা।

৬.  শিশুর ব্যয়ভার বহনে সক্ষম হওয়া।

৭.  শিশুর প্রতিপালনে প্রতিবন্ধক এমন কোনো শারীরিক বা মানসিক রোগে আক্রান্ত না হওয়া।

সময়কাল : শিশু ভালো-মন্দের পার্থক্য করতে শেখা এবং নিজের কাজ নিজে করতে পারা পর্যন্ত প্রতিপালনের এই অধিকার মায়ের থাকবে। ফকিহদের মতে শিশুরা সাধারণ সাত-আট বছর বয়সে এই সামর্থ্য লাভ করে।

খ. জীবনসংক্রান্ত অভিভাবকত্ব : শিশুর জীবনসংক্রান্ত (ওয়ালায়াত আলান-নাফস) দ্বারা শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ, তার জীবনের নিরাপত্তা ও শিক্ষা-দীক্ষা নিশ্চিত করা। হানাফি মাজহাব অনুসারে বাবার অবর্তমানে এমন অভিভাবকত্ব প্রথমে দাদা লাভ করবে। তারপর ভাই। অতঃপর চাচা। আর তারা না থাকলে মা অভিভাবকত্ব লাভ করবে। মা না থাকলে অন্যান্য আত্মীয়ের দিকে তা প্রত্যাবর্তিত হবে।

সময়কাল : শিশু সাবালক হওয়া পর্যন্ত এই অভিভাবকত্ব বহাল থাকবে।


গ. সম্পদসংক্রান্ত অভিভাবকত্ব : শিশুর সম্পদসংক্রান্ত (ওয়ালায়াত আলাল মাল) অভিভাবকত্ব দ্বারা বোঝায় শিশুর সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ, তা ক্রয়-বিক্রয় ও ইজারা দেওয়ার অধিকার। হানাফি মাজহাব অনুসারে পিতার অবর্তমানে এই প্রকারের অভিভাবকত্ব লাভ করবে পিতার অসিয়তকৃত ব্যক্তি। অতঃপর দাদা। তারপর দাদার অসিয়তকৃত ব্যক্তি। এরপর ইসলামী রাষ্ট্রের বিচারক কর্তৃক নিযুক্ত ব্যক্তি।

সময়কাল : শিশু সাবালক হওয়া পর্যন্ত এই অভিভাবকত্ব বহাল থাকবে।

মা অভিভাবকত্ব পেতে চাইলে : বাবার অবর্তমানে সন্তানের আইনি অভিভাবকরা যদি তার প্রতি কল্যাণকামিতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয় অথবা তারা অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালনে সক্ষম না হয়; অন্যদিকে মা সন্তানের জীবন ও সম্পদ বিষয়ে অভিভাবকত্ব লাভ করতে চান, তবে তিনি আদালতের দ্বারস্থ হতে পারবেন। আদালত মায়ের সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে এ বিষয়ে রায় প্রদান করবে। অথবা সম্পদের ব্যাপারে যদি বাবা বা দাদা মাকে অসি নিযুক্ত করে, তবে সে অভিভাবক হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারবে। (আল-ফিকহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহু : ১০/৭৩২৮)

পিতৃপরিচয়হীন শিশুর অভিভাবকত্ব : যেসব শিশুর পিতৃপরিচয় জানা না যায়, তারা মায়ের পরিচয়ে বড় হবে। সব ক্ষেত্রে মা-ই তার অভিভাবক হবেন। পিতৃপরিচয়হীন শিশুর সামাজিক ও ধর্মীয় বিধানের ক্ষেত্রে খুব সামান্য পার্থক্য আছে, তবে এমন শিশুরা পরিপূর্ণ সামাজিক সদাচার লাভ করবে। কেননা পবিত্র কোরআনে এমন শিশুকে ‘মুমিনদের ভাই ও বন্ধু’ বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা তাদের ডাকো তাদের পিতৃ-পরিচয়ে, আল্লাহর দৃষ্টিতে এটা অধিক ন্যায়সংগত। যদি তোমরা তাদের পিতৃ-পরিচয় না জানো, তবে তারা তোমাদের দ্বিনি ভাই এবং বন্ধু।’ (সুরা : আহজাব, আয়াত : ৫; আল-বিনায়া : ৪/১০১)

আল্লাহ সবাইকে সুপথ দান করুন। আমিন

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments