ইউনেসকোর ২৬তম অধিবেশনের সিদ্ধান্তে ১৯৯৪ থেকে প্রতিবছর প্রায় দুই শ দেশে ৫ অক্টোবর পালিত হয় ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’। ১৯৬৬ প্যারিস সন্মেলনে ১৩টি অধ্যায়, ১৪৬টি ধারা-উপধারায় শিক্ষকের মর্যাদা ও অধিকারের জন্য প্রণীত সুপারিশে : চিকিৎসা, স্বাস্থ্যসেবা, ছুটি বেতন-ভাতা ও মর্যাদার ক্ষেত্রে আছে (ক) সম্মানজনক পারিতোষিক নিশ্চিতকরণ, (খ) যুক্তিসংগত জীবনমান বিধানকল্পে সুবিধাদি নিশ্চিতকরণ, (গ) স্কেল অনুযায়ী নিয়মিত বেতন-ভাতাদি প্রাপ্তির নিশ্চয়তা, (ঘ) জীবনধারণের ব্যয়বৃদ্ধির সঙ্গে বেতন কাঠামো পূনর্বিন্যাস ও বর্ধিত বেতন প্রাপ্তির নিশ্চয়তা ইত্যাদি। কিন্তু বাংলাদেশের অনেক শিক্ষকের যাপিতজীবনের রূঢ় বাস্তবতায় শিক্ষকতা একটি নির্মোহ পেশা ও বঞ্চনার পরিভাষা।
বলা চলে, জাতিকে খাড়া ও সোজা রাখার শক্তি জোগায় যারা, তারাই ‘মানুষ গড়ার কারিগর’ শিক্ষক এবং Life student ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ব্যক্তিত্ব, উপাচার্য ড. মো. আখতারুজ্জামান এক সংবর্ধনায় তাঁরই শিক্ষক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইব্রাহিমকে দাঁড়িয়ে সম্মান জানান এবং পা ছুঁয়ে সালাম করে ‘শিক্ষকের মর্যাদা’র প্রমাণ রাখেন। কবির ভাষায়:
“…. শিক্ষক আমি শ্রেষ্ঠ সবার
দিল্লির পতি সে তো কোন ছার,
ভয় করি না’ক, ধারি না’ক ধার, মনে আছে মোর বল…
আজ হতে চির-উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির…”।
শিক্ষকতা একটি মহান পেশা, আর্থিক মূল্যমানে তা পরিমাপ করা যায় না। কেননা, মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি সমান হতে পারে?’ (সুরা জুমার, আয়াত : ০৯)
তিনি আরো বলেন, ‘যাকে জ্ঞান দান করা হয়েছে তাকে প্রভুত কল্যাণ দান করা হয়েছে। ’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৬৯)
এ প্রসঙ্গে প্রিয় নবী (সা.) বলেন, প্রকৃত জ্ঞানী সে যে নিজে যা জানে সে অনুযায়ী আমল করে। ’ একজন শিক্ষক উচ্চ নৈতিকতাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব, সমাজের আদর্শ চিকিৎসক ও শ্রেষ্টত্বের দ্যুতি বহন করেন তিনি। প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘নৈতিকতার বিচারে যে লোক উত্তম মুমিনদের মধ্যে সেই পূর্ণ ঈমানের অধিকারী। ’ (তিরমিজি)
প্রিয় নবী (সা.) আরো বলেন, ‘কল্যাণকর বিদ্যা দানকারীর জন্য (প্রাণী ও প্রকৃতির) সবাই আল্লাহ্র কাছে (দোয়া) মাগফিরাত কামনা করে। ’ (তিরমিজি)
প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়েই সাওয়াবের অধিকারী। ’ (ইবন মাজাহ)
প্রিয় নবী (সা.) আরো বলেন, ‘সর্বোত্তম দান হলো কোনো মুসলমান নিজে কোনো বিষয়ে জ্ঞানার্জন করে পরে তা কোনো মুসলমান ভাইকে শিক্ষা দেয়। ’ (ইবন মাজাহ)
পবিত্র কোরআনের আলোকে জ্ঞান তিন প্রকার ‘ইলমুল ইয়াকিন’ বা বিশ্বাসগত জ্ঞান, ‘আইনুল ইয়াকিন’ বা চাক্ষুষ জ্ঞান এবং ‘হাক্কুল ইয়াকিন’ বা সত্যজ্ঞান। আবার জ্ঞানের কারণেই মানুষ হয় নন্দিত, যার মূল উৎস ‘ওয়াহি’ এবং প্রিয় নবী (সা.)-এর ‘সুন্নাহ’। অন্যদিকে মূর্খতা ডেকে আনে পতন-পরাজয়।
‘আইয়্যামে জাহিলিয়্যাতে’ আরবে শিক্ষিত লোক ছিলেন মাত্র ১৭ জন, ফলে তৎকালীন সমাজ ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছিল। তাই মহান আল্লাহ ওই বিলীয়মান সমাজে সর্বপ্রথম যে আদেশটি দিলেন তা হলো—‘পাঠ করো তোমার প্রভুর নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন…তিনি মানুষকে তাই শিখিয়েছেন, যা সে জানত না। ’ (সুরা আলাক, আয়াত : ০১-০৫)
এতে বোঝা যায়, অজানাকে জানা তথা জ্ঞানচর্চা একটি সার্বক্ষণিক ফরজ কর্তব্য এবং কোরআনি নির্দেশনার প্রথম ফরজ। প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞানান্বেষণ করো। ’
প্রিয় নবী (সা.) নিজের সম্পর্কে বলতেন, ‘বু-ইস্তু মুআল্লিমান’ অর্থাৎ আমাকে শিক্ষক হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে। ’ (ইবন মাজাহ)
বস্তুত ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবসে’র তাৎপর্যপূর্ণ অপরিসীম। কেননা, ইলম ও আমলের সমন্বিত ধারায় বিকশিত মানুষ সবচেয়ে মর্যাদাবান ও সফল।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, কাপাসিয়া, গাজীপুর