Friday, March 29, 2024
spot_img
Homeনির্বাচিত কলামইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি ও বাংলাদেশ

ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি ও বাংলাদেশ

শাহাদাৎ হোসাইন স্বাধীন

এছাড়া সমুদ্র অর্থনীতি, খনিজ সম্পদ আহরণ, পোর্ট ট্রানজিন ব্যবহারের অনুমতি দিয়েও বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারে। বাংলাদেশ সরকারের আই পি এস নিয়ে বিশেষ করে এর অর্থনৈতিক ফ্রেমওয়ার্ক নিয়ে আগ্রহও রয়েছে। ২০১৮ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পকে লেখা এক চিঠিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উল্লেখ করেন ‘সবার জন্য সমৃদ্ধি বয়ে আনবে এমন স্বাধীন, উন্মুক্ত, শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ ইন্দো-প্যাসিফিক ভিশন বিষয়ে বাংলাদেশ একমত পোষণ করে।’ ফলে ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক-এ অংশগ্রহণ করা বাংলাদেশের জন্য একটি সময়ের পরীক্ষিত সিদ্ধান্ত হতে চলেছে। আইপিইএফ-এ যোগদান করে একটি অনুকূল গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের মাধ্যমে এই অঞ্চলের বাজারে উদীয়মান অর্থ শক্তি হিসেবে জায়গা করে নিতে পারে বাংলাদেশ


ভৌগোলিক বাস্তবতায় বিশ্বরাজনীতি ও অর্থনীতির মূল কেন্দ্রে পরিণত হতে যাচ্ছে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল। এই অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান, অপার সমুদ্র অর্থনীতির সম্ভাবনা, বিশাল বাজার ও কৌশলগত অবস্থানের কারণে বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলো ইন্দো- প্যাসিফিক অঞ্চল নিয়ে নিজেদের স্ট্র্যাটেজি তৈরি করছে। ক্রমবর্ধমান গুরুত্বের কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছেও ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশসহ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলো বৃহৎ শক্তিদের প্রতিযোগিতামূলক অগ্রসরতা থেকে লাভবান হতে পারে। বাংলাদেশ ভূ-রাজনৈতিকভাবে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থলে অবস্থিত। ফলে বাংলাদেশ রয়েছে ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলের কেন্দ্রস্থলে। এই অঞ্চলের গুরুত্বায়ন বাংলাদেশের গুরুত্ব বৃদ্ধি করে।

 ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ উপসাগর হলো বঙ্গোপসাগর। বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমার এই সাগরের জলসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তি করেছে আন্তর্জাতিক আদালতে। ২১,৭২,০০০ বর্গকিলোমিটারের এই ITLOS (The International Tribunal for the Law of the SeaSea) ও PCA (Permanent Court of Arbitration) এর ২০১২ সালের রায়ের পর বঙ্গোপসাগরের ১,১৮,৮১৩ কিলোমিটার সমুদ্রজুড়ে অর্থনৈতিক ও নিরঙ্কুশ সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ উপসাগরের রয়েছে বিশাল জলরাশি। এর পশ্চিম প্রান্তে ভারত, পূর্ব প্রান্তে থাইল্যান্ড।

 সাগরের তীরবর্তী অন্য দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ। পরোক্ষ নির্ভরশীলতা রয়েছে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্য কয়েকটি দেশেরও।  বিশ্ববাণিজ্যে পরিবাহিত পণ্যের এক-চতুর্থাংশ যায় বঙ্গোপসাগরের ওপর দিয়ে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে জ্বালানি স্বল্পতায় ভোগা দেশগুলোয় পারস্য উপসাগর হয়ে পরিবাহিত জ্বালানি তেল ও এলএনজির নিরাপদ করিডোর বঙ্গোপসাগর। এই সাগর ও সাগর তীরবর্তী দেশগুলোর মধ্যে একে অপরের ওপর বলপ্রয়োগ, কারও জলরাশি বা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ খুব একটা শোনা যায় না। বঙ্গোপসাগর হয়ে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে সার্ক, আসিয়ান, বিমসটেকের মতো সক্রিয় আঞ্চলিক জোটের বিকাশ ঘটেছে। দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বিষয়টি অনেকটাই নির্ভর করে বিশ্বের বৃহত্তম উপসাগর বঙ্গোপসাগরের ওপর। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন দেশগুলোর ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য। দুই অঞ্চলের সংযোগ স্থাপনকারী এ উপসাগর আবার প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ। ভূরাজনৈতিক অবস্থান, বঙ্গোপসাগরে সার্বভৌমত্ব ও একটি অগ্রসরমান অর্থনীতি হিসেবে বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ খুঁটি হয়ে উঠেছে।   

ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি: আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে সাম্প্রতিক সময়ে গোটা ইন্দো প্যাসিফিককে ‘মুক্ত ও অবাধ’ অঞ্চল হিসেবে গড়ে তুলতে একটি প্রস্তাবনা পেশ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশিত ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি অনুযায়ী, প্রশান্ত মহাসাগরের মার্কিন উপকূল থেকে গোটা ভারত মহাসাগর এর অন্তর্ভুক্ত। অস্ট্রেলিয়া থেকে ২০১৭ সালে প্রকাশিত ফরেন পলিসি হোয়াইট পেপারে বলা হয়েছে, পূর্ব ভারত মহাসাগর থেকে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল। আবার ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের স্ট্র্যাটেজি অনুযায়ী আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল থেকে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত এখানে একটি জিনিস পরিষ্কার ভৌগোলিকভাবে প্রতিটি দেশ বা অঞ্চলের ইন্দো-প্যাসিফিক মানচিত্রে বাংলাদেশের অবস্থান রয়েছে।  যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি (আই পি এস) বা কৌশলের প্রধান লক্ষ্য হলো অঞ্চলটিকে অবাধ ও মুক্ত, সংযুক্ত, সমৃদ্ধ, সুরক্ষিত এবং স্থিতিস্থাপক করে তোলা। ঘোষিত ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির রাজনৈতিকভাবে যে ভিশন রয়েছে তার চারটি মূল্যবোধভিত্তিক উপাদান রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে, প্রতিটি দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতাকে সম্মান, শান্তিপূর্ণ উপায়ে দ্বন্দ্ব নিরসন, স্বাধীন ও উন্মুক্ত বাণিজ্য এবং আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা। আই পি এস ঘোষণা দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, ‘আমরা এমন এক ইন্দো-প্যাসিফিকের স্বপ্ন দেখছি, যেটি মুক্ত, সংযুক্ত, সমৃদ্ধ, স্থিতিস্থাপক ও সুরক্ষিত এবং আমরা প্রত্যেকের সঙ্গে একজোট হয়ে কাজ করে এই লক্ষ্য অর্জন করতে চাই।’ 

আই পি এস- এর  অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রস্তাব রয়েছে যাকে ইন্দো- প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক বা আইপিইএফ বলা হচ্ছে। আইপিইএফ-এর চারটি প্রধান ক্ষেত্র ডিজিটাল অর্থনীতি, সাপ্লাই চেইন, ক্লিন এনার্জি অবকাঠামো এবং দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপ নিয়ে পারস্পরিক সম্মতিতে মানদণ্ড  নির্ধারণ করবে। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেছেন, ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল কোনো সামরিক জোট নয়। ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল যুক্তরাষ্ট্রপন্থি অঞ্চল বা চীনপন্থি অঞ্চলের মধ্যেকার প্রতিযোগিতাও নয়।’ তবে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ছাড়াও ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে কোয়াড্রিল্যাটেরাল সিকিউরিটি ডায়লগ (কোয়াড) এবং অস্ট্রেলিয়া, বৃটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ত্রিপক্ষীয় নিরাপত্তা চুক্তির (অউকাস) মতো অংশীদারিত্ব নিরাপত্তা জোটের সঙ্গেও কাজ করছে।  

পরাশক্তিদের প্রতিযোগিতা ও বাংলাদেশের সম্ভাবনা: দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় চীনের প্রভাববৃত্ত অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক, সামরিক ও প্রযুক্তি খাতে তীব্র হচ্ছে। অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতি হিসেবে বর্তমান বাজার দখল করছে ভারত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি ঘোষণার মাধ্যমে মূলত এই অঞ্চল নিয়ে দেশটির আগ্রহ ও পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের মতো বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে এই অঞ্চলে একটি আগ্রহের প্রতিযোগিতা তৈরি হচ্ছে। সব দেশই নিজ নিজ পলিসি নিয়ে ছোট ছোট দেশগুলোকে নিজেদের পরিকল্পনায় যুক্ত করতে চাচ্ছে। বৃহৎ অর্থনীতির এমন প্রতিযোগিতার মধ্যে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্কের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিনিয়োগ ও বাণিজ্য খাতে লাভবান হতে পারে। বাংলাদেশ নিজেও একটি উদীয়মান অর্থনীতি। ২০৪০ সালের দিকে ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি হতে পারে  বলে ধারণা করা হচ্ছে। আমদানি রপ্তানিতে দেশটি তার অর্থনীতির পরিসর বাড়াচ্ছে।

 বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনেও ঝুঁকিতে থাকা একটি দেশ। ফলে ইন্দো- প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির জলবায়ু পরিবর্তন, মুক্ত বাণিজ্য ও স্থিতিশীল উন্নয়নের মতো সহযোগিতার প্রস্তাবনায় যুক্ত হতে পারলে তা বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে সমৃদ্ধ করবে।  দক্ষিণ এশিয়া প্রায় দেড় বিলিয়ন মানুষের বৃহৎ বাজার। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সম্মিলিত জিডিপি ৩ ট্রিলিয়ন পার করেছে। এই অঞ্চল বিশ্বের মোট বাণিজ্যের ১০% নিয়ন্ত্রণ। দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া  এবং এর বিস্তৃত অঞ্চল এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের অংশ। বড় দুইটি অঞ্চলের সেতুবন্ধনকারী বাংলাদেশের সুযোগ রয়েছে দুই অঞ্চলের যোগাযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠার। বাংলাদেশের সস্তা শ্রম, অবকাঠামো ও কৌশলগত অবস্থান কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে পণ্য সহজেই ভারতে ও আসিয়ান অঞ্চলে রপ্তানি করতে পারবে।  এছাড়া সমুদ্র অর্থনীতি, খনিজ সম্পদ আহরণ, পোর্ট ট্রানজিন ব্যবহারের অনুমতি দিয়েও বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারে। বাংলাদেশ সরকারের আই পি এস নিয়ে বিশেষ করে এর অর্থনৈতিক ফ্রেমওয়ার্ক নিয়ে আগ্রহও রয়েছে।

 ২০১৮ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পকে লেখা এক চিঠিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উল্লেখ করেন ‘সবার জন্য সমৃদ্ধি বয়ে আনবে এমন স্বাধীন, উন্মুক্ত, শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ ইন্দো-প্যাসিফিক ভিশন বিষয়ে বাংলাদেশ একমত পোষণ করে।’ ফলে ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক-এ অংশগ্রহণ করা বাংলাদেশের জন্য একটি সময়ের পরীক্ষিত সিদ্ধান্ত হতে চলেছে। আইপিইএফ-এ যোগদান করে একটি অনুকূল গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের মাধ্যমে এই অঞ্চলের বাজারে উদীয়মান অর্থ শক্তি হিসেবে জায়গা করে নিতে পারে বাংলাদেশ।   

লেখক: কলামিস্ট shahadatju44@gmail.com

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments