সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে ইউক্রেনে হামলা চালিয়েছে রাশিয়া। ইউরোপ-আমেরিকার কোনো হুঁশিয়ারিই কাজে আসেনি। বৃহস্পতিবার ভোরে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেন। ঠিক এর পরপরই দফায় দফায় গোলাবর্ষণ ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু করে রুশ বাহিনী। তিন দিক থেকে ইউক্রেনে ঢুকে পড়ে রাশিয়ার পদাতিক বাহিনীও।
বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে ওঠে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ। হামলা হয়েছে আরও কিছু শহরে, পোদিলস্ক শহরের সেনা ঘাঁটিতেও। এসব হামলায় ৪০ সেনা ও ১০ বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন বলে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে।
আহত হয়েছেন শতাধিক মানুষ। এছাড়া নিখোঁজ রয়েছেন অর্ধ-শতাধিক ব্যক্তি। হামলার আগে রাতে এক ভিডিও বার্তায় ইউক্রেনে এক মাসের জরুরি অবস্থা জারি করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলনস্কি।
ইউক্রেনে রুশ হামলা বিশ্ব রাজনীতিতে এক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। অবস্থা শেষ পর্যন্ত কোথায় গড়ায়, তা ভেবে শঙ্কিত বিশ্ববাসী। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেছেন, ইউক্রেনে রুশ অভিযানের প্রেক্ষিতে কেউ নাক গলালে তাৎক্ষণিক জবাব দেওয়া হবে; অন্যদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বক্তব্য হলো-ন্যাটো অঞ্চলের প্রতি ইঞ্চি জমি রক্ষা করা হবে।
অর্থাৎ পরিস্থিতি অনেকটা অতীতের সোভিয়েত-মার্কিন স্নায়ুযুদ্ধকালীন পরিস্থিতির মতো। বর্তমানে যা ঘটছে, সেটাকে বলা যায় রুশ আগ্রাসন, পুরোপুরি যুদ্ধ নয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই আগ্রাসন যে বড় আকারের যুদ্ধে পরিণত হবে না, তা বলা যায় না। অনেকে আবার তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কাও করছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে শঙ্কিত বিশ্ববাসী যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছেন।
যুদ্ধ থামানোর আকুতি জানাচ্ছেন তারা। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস মানবতার দোহাই দিয়ে যুদ্ধ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন। তার কণ্ঠের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে আমরাও বলতে চাই, যুদ্ধ কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। যুদ্ধ কখনো কল্যাণ বয়ে আনে না। মানবজীবন ও সম্পদের ধ্বংস ছাড়া বিশ্ব সভ্যতাকে যুদ্ধ কিছুই দিতে পারে না। তাই যে কোনো মূল্যে শান্তি বজায় রাখতে হবে বিশ্বে।
বর্তমান যুদ্ধ পরিস্থিতি সারা বিশ্বে বিরূপ প্রভাব ফেলবে, সন্দেহ নেই। বাংলাদেশও এই প্রভাবমুক্ত থাকতে পারবে না। প্রথমত, জ্বালানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি আমদানিনির্ভর দেশ। যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে তেলের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যেই ব্যারেলপ্রতি তেলের দাম ১০০ ডলার ছাড়িয়েছে। তেলের এই মূল্যবৃদ্ধির চাপ সহ্য করতে হবে বাংলাদেশকেও।
দ্বিতীয়ত, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাস্তবায়িত হচ্ছে রাশিয়ার সহযোগিতায়; রাশিয়ার ওপর যদি পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, তাহলে অনিশ্চিত হয়ে পড়বে এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন। তৃতীয়ত, বিশ্বের সরবরাহ ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। আমাদের তৈরি পোশাক খাত হলো টাইম-সেন্সেটিভ অর্থাৎ সময়নির্ভর। সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়লে এ খাত সমূহ ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
চতুর্থত, আমরা যে গম আমদানি করি, তা আসে মূলত রাশিয়া, ইউক্রেন ও বেলারুশ থেকে। এই আমদানি তথা খাদ্যমূল্যের ওপর চাপ সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এছাড়া ইউক্রেনে রুশ হামলা ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর নিরাপত্তার জন্য এক বড় হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে।
এসব নিশ্চয়ই এক বড় ভাবনার বিষয়। সবটা মিলিয়ে আমরা বলব, বাংলাদেশকে সতর্ক অবস্থানে থাকতে হবে। সংঘাত-যুদ্ধে পক্ষ অবলম্বনের প্রশ্নে বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে। আমাদের পররাষ্ট্রবিষয়ক যে মূলনীতি-সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়-এই নীতিই হতে পারে বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের নির্দেশিকা।