Monday, March 20, 2023
spot_img
Homeআন্তর্জাতিকআসল প্রশ্ন কোনটি

আসল প্রশ্ন কোনটি

বিষয়টি এখন সুপ্রিম কোর্টে। আশা থাকল, সর্বোচ্চ আদালতে সঠিক প্রশ্নগুলি উঠবে, সংবিধানের মূল নীতি মেনে বিচারের রায় প্রকাশিত হবে। 

বিচারশাস্ত্রে একটি পরিচিত শব্দবন্ধ, ‘সাংবিধানিক ভাবে অনৈতিক’। বিচারপ্রক্রিয়ায় কোনও কিছু যদি এমন ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়, যা সংবিধান ভুল ভাবে পড়বার ফলে ঘটে থাকে— তাকেই এই ভাবে চিহ্নিত করা দস্তুর। সম্প্রতি হিজাব পরার অধিকার সংক্রান্ত মামলা কর্নাটক হাই কোর্টে পৌঁছনোর পর সমগ্র আলোচনা যে দিকে চলে গেল, এবং যে তর্কবিতর্কের মাধ্যমে হিজাব পরিধান ভারতীয় উচ্চ আদালতে বিচারের স্বীকৃতি পেল না, তা দেখে এই শব্দবন্ধই মনে পড়ে। আশ্চর্য হতে হয়, হিজাবের অধিকারের সমস্ত আলোচনাটি ঘুরতে থাকল ‘এসেনশিয়াল রিলিজিয়াস প্র্যাকটিস’ বা আবশ্যিক ধর্মীয় আচার-কে কেন্দ্র করে, যেন ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রশ্নটা একেবারেই উহ্য, অপ্রাসঙ্গিক, অদরকারি। অথচ, ভারতীয় সংবিধানে ব্যক্তি-অধিকারের যে বিষয়গুলি একেবারে ভিত্তিপ্রতিম, তার মধ্যেই কি এই বিষয়টি পড়ে না? গণতান্ত্রিক দেশে খাদ্য কিংবা পোশাক পছন্দ করার অধিকার কি ব্যক্তির নেই? ধর্মীয় কিংবা অধর্মীয়— সে সব বিচার তো গৌণ। যদি কেউ ধর্মীয় ভাবে অনাবশ্যক কিন্তু পছন্দের সংস্কৃতি অনুযায়ী আবশ্যক পোশাক পরার অধিকার দাবি করেন— এবং তা কোনও ভাবে অন্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না, কী সমস্যা তাতে? একই ভাবে, যদি কেউ ধর্মসম্প্রদায়ের নির্দেশ সত্ত্বেও কোনও পোশাক না পরতে চান, তিনিও তা করতে পারেন, সর্বতো ভাবে তা গণতান্ত্রিক দেশে আইনসিদ্ধ হওয়ার কথা! অর্থাৎ পোশাক পরা বা না-পরা, ভারতীয় বিচারবিধি কোনও ক্ষেত্রেই বাধা দিতে পারে না। ব্যক্তির উপরেই সেই সিদ্ধান্ত ছাড়ার কথা। বিচারবিভাগের উপর আস্থা না রেখে নাগরিকের উপায় নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, কর্নাটক হাই কোর্টের রায়টি অতি আপত্তিকর, ব্যক্তি-অধিকারবিরুদ্ধ, এবং সেই অর্থে, সংবিধান-অনুগ নয়।

অধিকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ছাড়াও এই রায়ের মধ্যে আর একটি বিষয়ের অনুপস্থিতি অতীব পীড়াদায়ক— সহানুভূতি। সাধারণ ভাবে, ‘সহ’ অনুভূতি কথাটির উপর জোর না দিয়ে অনেক সময়ে শব্দটিকে কৃপা অর্থে ব্যবহার করা হয়। অথচ, বিষয়টি কিন্তু কৃপা নয়, সহ-অনুভবেরই। মুসলমান মেয়েদের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের সঙ্কট বোঝার ক্ষমতা। তাঁরা যদি একটি বিশেষ পোশাক পরে তবেই বিদ্যাশিক্ষার সুযোগ পান, তা হলে কোনটি বেশি জরুরি— পোশাকটিকে নিষিদ্ধ করে তাঁদের শিক্ষাবঞ্চিত করা, না কি পোশাকে অন্যদের ‘অসুবিধে’ হলে অন্যদেরই মানিয়ে নিতে বলা, যাতে মেয়েরা শিক্ষার সুযোগটি কাজে লাগাতে পারেন? এত সামান্য কারণে এত বড় একটি অসুবিধের মধ্যে মুসলমান মেয়েদের সংখ্যাগুরু অসহিষ্ণুতার গহ্বরে ঠেলে দেওয়া হল— বিচারের সহ-অনুভূতিহীনতার কারণেই তা ঘটতে পারল। গণতান্ত্রিক ভারত আজ মরমে মরছে, বিচারের বাণীর এই অবনমন দেখে। বিষয়টি এখন সুপ্রিম কোর্টে। আশা থাকল, সর্বোচ্চ আদালতে সঠিক প্রশ্নগুলি উঠবে, সংবিধানের মূল নীতি মেনে বিচারের রায় প্রকাশিত হবে।

স্বভাবতই প্রতিবাদ, বিক্ষোভ শুরু হয়েছে, হুমকিও শোনা যাচ্ছে কর্নাটক হাই কোর্টের রায়ের ফলে। কর্নাটকে সম্প্রদায়-সম্প্রীতি বিজেপি শাসনে অনেক দূর ক্ষতিগ্রস্ত, এই ঘটনা সেই ক্ষত আরও অনেকটা বাড়িয়ে দিতে সমর্থ হল। প্রকৃত উদ্বেগের কারণ এইখানেই। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ ছড়িয়ে, কারণে অকারণে তাদের প্রতি আক্রমণ শাণিয়ে, নির্যাতিত করে যে হিন্দুত্ববাদী সমাজ প্রতি দিন এ দেশের সামাজিক স্থিতি নষ্ট করতে ব্যস্ত, সেই পরিপ্রেক্ষিতে সংখ্যালঘু কিংবা অন্যান্য শুভবোধসম্পন্ন নাগরিকের একমাত্র ভরসা বিচারবিভাগ। সেখানেও যদি সুবিচারের বোধ মেঘাবৃত হয়ে যায়, আশার আর কিছু বাকি থাকে না। গণতান্ত্রিক নীতির পৌনঃপুনিক ও মাত্রাছাড়া লঙ্ঘনের ফলে নাগরিকের অসহায়তা ক্রমশই অসহনীয় হয়ে উঠছে।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments