পবিত্র কোরআনে আল-আকসাকে বরকতময় (আল্লাহর অনুগ্রহপ্রাপ্ত) ভূমি বলা হয়েছে। আধ্যাত্মিকতার দৃষ্টিতে আল্লাহর অনুগ্রহ মানুষের জন্য বিশেষায়িত নয়; বরং আল্লাহর সমগ্র সৃষ্টি তা থেকে উপকৃত হতে পারে।
তবে মানুষ তা থেকে উপকৃত হয় শারীরিক ও আধ্যাত্মিকভাবে। এ জন্য সুফিদের কাছে আধ্যাত্মিক সাধনার জন্য আল-আকসা ছিল অত্যন্ত প্রিয় স্থান।
পবিত্র কোরআনে মারিয়াম (আ.) ও জাকারিয়া (আ.)-এর যে বিবরণ এসেছে তা থেকে বোঝা যায়, তারা মসজিদুল আকসায় আধ্যাত্মিক সাধনায় সময় কাটিয়েছিলেন। মসজিদুল আকসার সঙ্গে স্মৃতি জড়িয়ে আছে—এমন তিনজন বিশ্ববিখ্যাত মুসলিম সুফির স্মৃতি তুলে ধরা হলো।
রাবেয়া বসরি (রহ.)
খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকের বিখ্যাত নারী সাধক রাবেয়া আল-আদাবিয়্যাহ, যিনি রাবেয়া বসরি নামে বেশি পরিচিত, তিনি জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য সময় কাটান জেরুজালেমে। তিনি বসরার অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু ধার্মিকতা ও সাধনার মাধ্যমে তিনি যুগশ্রেষ্ঠ সুফি সাধকে পরিণত হন। জগদ্বিখ্যাত আলেম সুফিয়ান সাওরি (রহ.) ও শুবা ইবনুল হাজ্জাজ (রহ.) ছিলেন তাঁর শিষ্য। রাবেয়া বসরি (রহ.) ছিলেন একজন দাসী ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী। একদিন এক পুরুষ আগন্তুককে তাঁর পালিয়ে যাওয়া দেখে মালিক তাঁকে মুক্ত করে দেন। মুক্ত হওয়ার পর তিনি জেরুজালেম চলে আসেন এবং সেখানেই বসতি স্থাপন করেন। এখানেই তিনি আধ্যাত্মিক সাধনা ও মানবসেবায় জীবন কাটিয়ে দেন। বলা হয়ে থাকে তিনি ছিলেন ‘ঐশ্বরিক ভালোবাসা’ ধারণার পথপ্রদর্শক। দূর-দূরান্ত পর্যন্ত তাঁর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। যা অন্যান্য সাধক ও আলেমদের আল-আকসার প্রতি আকৃষ্ট করে। ‘আল্লাহপ্রেমে’ উৎসর্গিত জীবন কাটিয়ে জেরুজালেমেই তিনি ইন্তেকাল করেন। জেরুজালেমের ‘তুর জেইতা’ পাহাড়ের চূড়ায় তাঁকে দাফন করা হয়।
প্রখ্যাত আলেম ও সুফিসাধক ইবনুল জাওজি (রহ.) ও ফরিদুদ্দিন আত্তার (রহ.) ছিলেন রাবেয়া বসরি (রহ.) দ্বারা প্রভাবিত আলেমদের অন্যতম। যুগশ্রেষ্ঠ আলেমদের মধ্যে ইমাম গাজালি (রহ.) ছিলেন তাঁর দ্বারা বেশি প্রভাবিত।
ইমাম গাজালি (রহ.)
ইমাম গাজালি (রহ.) সেই মহান মুসলিম দার্শনিক আলেম ও সুফি সাধক, যিনি গ্রিক দার্শনিক, যারা যুক্তি ও ঐশী জ্ঞানের মধ্যে বিভাজন রেখা টেনে দিয়েছিল তাদের চ্যালেঞ্জ করেছিলেন এবং তিনি ইসলামী আইন শাস্ত্র ও সুফিবাদের মধ্যে সম্পর্ক প্রমাণ করেছিলেন। তিনিও রাবেয়া বসরি (রহ.)-এর মতো জেরুজালেমে স্থানান্তরিত হয়েছিলেন এবং সেখানে ১০ বছরের চেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছিলেন। আল-আকসা প্রাঙ্গণে বসে তিনি তাঁর বিখ্যাত কয়েকটি গ্রন্থও রচনা করেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘আল-কিস্তাস’, ‘মাহকুন নাজরি’ ও ‘ইহইয়াউ উলুমুদ্দিনে’র একাংশ। ইহইয়াউ উলুমুদ্দিন রচনা করেন আল-আকসার বাবে রহমতের ছাদে বসে।
ক্রুসেডাররা বায়তুল মোকাদ্দাসের দিকে অগ্রসর হচ্ছে শুনে তিনি জেরুজালেম ত্যাগ করেন, যেন মানুষকে এই পুণ্যভূমি রক্ষায় উদ্বুদ্ধ করতে পারেন। এ সময় তিনি বাগদাদে সুলতান নুরুদ্দিন জঙ্গি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক হন এবং সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবিব (রহ.) ইমাম গাজালি (রহ.)-এর রচনাবলিকে পাঠ্যভুক্ত করেন। তাঁর রচনা মানুষকে বায়তুল মুকাদ্দাস পুনরুদ্ধারে উৎসাহিত করে।
সুফি ফরিদুদ্দিন গঞ্জেশকর (রহ.)
সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবি (রহ.) জেরুজালেম উদ্ধারের কয়েক দশক পর ভারতবর্ষের বিশিষ্ট আলেম ও সুফি সাধক ফরিদুদ্দিন গঞ্জেশকর (রহ.) জেরুজালেম আসেন। তিনি বাবা ফরিদ নামেও পরিচিত। তিনি বায়তুল মুকাদ্দাসে আসেন কয়েক মাসের জন্য। হজের আগে আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর নির্দেশ মান্য করতে। কিন্তু তাঁর দেখাদেখি পরবর্তী সময়ে ভারতীয় মুসলিমরা হজের আগে বায়তুল মুকাদ্দাস সফর শুরু করেন।
ভারতীয় মুসলিমদের আগমনে জেরুজালেমে একটি খানকা প্রতিষ্ঠিত হয়, যা এখনো ‘ভারতীয় খানকা’ নামে পরিচিত। পুরনো জেরুজালেম শহরের যে স্থানে সুফি ফরিদুদ্দিন গঞ্জেশকর (রহ.) অবস্থান করেছিলেন তা এখনো চিহ্নিত আছে।
বলা হয়ে থাকে, যদিও সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবি (রহ.) বায়তুল মুকাদ্দাসের রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষা করেছিলেন, তবে সারা পৃথিবীর মুসলমানের অন্তরে তাঁর ভালোবাসা রক্ষা করেছিলেন সুফি সাধকরা।
মিডলইস্ট মনিটর অবলম্বনে