বায়ান্ন বছর আগে তিরিশ লক্ষ শহীদ এবং দুই লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জনকারী দেশ আমাদের প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশ। অর্ধ শতাব্দীর অধিক সময় যাবৎ স্বাধীনতা অর্জনকারী পৃথিবীর অনেক দেশের সাথে তুলনা করা হলে আমাদের অনেক ক্ষেত্রে দৃশ্যমান কিছু উন্নতি সাধন হলেও মারাত্মক ভাবে ব্যর্থ হয়েছে শিক্ষা এবং তার ব্যর্থতা ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। সে সম্পর্কে মৌলিক কিছু বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করছিঃ
১। আমাদের শিক্ষা পাঁচ দশকের অধিক সময়েও সৎ শিক্ষিত মানুষ তৈরি করতে পারেনি। কারণ দেশের অধিকাংশ তথাকথিত শিক্ষিত মানুষ অসৎ, দুর্নীতিবাজ!
২। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা দেশপ্রেমিক মানুষ তৈরি করতে পারেনি। কারণ অধিকাংশ তথাকথিত শিক্ষিত মানুষ দেশের সাধারণ মানুষের সম্পদ অবৈধভাবে লুটে নিয়ে দেশে বা বিদেশে জমা করে চলেছে।
৩। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সৎ, যোগ্য, দক্ষ, দেশপ্রেমিক ও ব্যক্তিত্ববান আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। এদের অধিকাংশ মেরুদন্ডহীন, ঘুস গ্রহিতা, ঘুস দাতা, দলপুজারী এবং ব্যক্তিপুজারী।
৪। আমাদের উচ্চ শিক্ষা দেশের মানুষকে সুশিক্ষিত করতে পারেনি। আমি দৃঢ়ভাবে বলতে পারি, ৯০% স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী শিক্ষিত মানুষ শুদ্ধ করে দশ বাক্য বাংলা এবং দশ বাক্য ইংরেজি লিখতেও পারে না, বলতেও পারেনা।
৫। মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ যে যে ধর্মাবলম্বীই হোক না কেন, তার ধর্ম বা ধর্মগ্রন্থ সম্পর্কে মৌলিক জ্ঞান নেই। ফলে ধর্ম ব্যবসায়ীরা সাধারণ মানুষকে নিয়মিত ধোঁকা দিয়ে চলেছে।
৬। দেশের উচ্চ শিক্ষায় তেমন কোন মৌলিক বা যুগোপযোগী গবেষণা কার্যক্রম নেই! যাও দু’একটা আছে তা দেশের কোন কাজে লাগানো হয় না। এছাড়া এসব গবেষণা কাজে অহরহ চৌর্যবৃত্তি রয়েছে!
৭। দেড় শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং হাজার হাজার স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হলেও সেসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ধারে কাছেও নেই। এছাড়া এসব অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের প্রশাসন আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত, অযোগ্য, সরকার দলীয় ক্যাডার, তেলবাজ, মেধাহীন এবং ব্যক্তিত্বহীন!
৮। মাধ্যমিক শিক্ষায় লক্ষ লক্ষ জিপিএ পাঁচ প্রাপ্ত শিক্ষার্থী সঠিকভাবে বাংলা ও ইংরেজি রিডিং পড়তে পারে না। অধিকাংশের মৌলিক জ্ঞান শুন্যের কোটায় ফলে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ভর্তি পরীক্ষায় ৮০-৯০% অকৃতকার্য হয়!
৯। প্রাথমিক বিদ্যালয় অতিক্রমকারী অধিকাংশ শিক্ষার্থী তাদের পাঠ্য বই পড়তে পারে না।
১০। দেশের প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সুযোগ্য, মেধাবী, দায়িত্বশীল,চৌকষ, আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষক সমাজ গড়ে তোলা হয়নি। শিক্ষকতাকে একটি অবহেলিত পেশায় পরিনত করা হয়েছে। এ পেশাকে চরম ভাবে আর্থিক দৈন্যতা, বৈষম্য ও উৎসাহ হীন করে রাখা হয়েছে।
১১। শিক্ষা কার্যক্রম বহুবিধ শাখা প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে চরম বিশৃঙ্খল অবস্থায় চলে গিয়েছে। বলতে গেলে এক্ষেত্রে সরকারের তেমন কোন নিয়ন্ত্রণ নেই।
১২। প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত কোথাও কোন কারিকুলাম যুগোপযোগী বা আন্তর্জাতিক মানের নয়।
১৩। দেশে দায়সারা গোছের একটি শিক্ষানীতি প্রণীত হলেও কোন শিক্ষা আইন নেই। কতিপয় অনভিজ্ঞ , অযোগ্য আমলা ও রাজনৈতিক নেতা মিলে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে দেশের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে!
১৪। দেশের ছাত্ররাজনীতি দলীয় ক্যাডার, চাঁদাবাজ ও অবৈধ অর্থ উপার্জনকারীদের হাতে চলে গেছে। মেধাবী শিক্ষার্থীরা ছাত্ররাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে!
১৫। শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আনুপাতিক হারে চরম বৈষম্য বিরাজ করছে!
১৬। আমরা বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, শব্দদূষণ, মাটিদূষণ, যানজট, রাস্তাঘাটে আবর্জনায় নিমজ্জিত। অর্থাৎ আকন্ঠ একটি নোংরা অপরিচ্ছন্ন জাতিতে পরিণত হয়েছি!
১৭। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পাঠ্যবই পড়ার চেয়ে বিসিএস গাইড পড়তে আগ্রহী বেশি! কারণ জ্ঞানার্জনের চেয়ে চাকরির প্রয়োজন বেশি; তাও আবার ঘুসের চাকরি!
১৮। মেধাবী শিক্ষার্থীরা ঝাঁকে ঝাঁকে দেশ ছেড়ে আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, মালয়েশিয়া চলে যাচ্ছে! কারণ দেশের সার্বিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক অবস্থা, চাকরির বাজার ইত্যাদি বিষয় তাদের ধরে রাখতে পারছে না।
১৯। স্বল্প শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের যুবক যুবতীরাও জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়ে জীবিকার তাগিদে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে এবং সেসব দেশে গিয়ে অনেকটা দাসদাসীর কাজ করছে!
২০। আমাদের শিক্ষা সৎ ও নির্লোভ রাজনীতিবিদ তৈরি করতে পারেনি। খুব সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ইউনিয়ন পরিষদের কাউন্সিলর থেকে শুরু করে দেশের শীর্ষ নেতা পর্যন্ত সবাই চোর ও ক্ষমতা লিপ্সু! দেশ ও জনগণের অর্থ চুরি করে তারা দেশে ও বিদেশে বিত্তবৈভব গড়ে তুলেছে। তারা একবার ক্ষমতা পেলে আর ছাড়তে চায়না। স্বাধীনতার পর একটি সরকারও স্বেচ্ছায় বা সানন্দে ক্ষমতা ছাড়েনি। রাজনীতিবিদদের আরো একটি ভয়ঙ্কর চরিত্র হলো নিজের স্ত্রী, পুত্র, কন্যা বা নিকটাত্মীয় ছাড়া অন্য কাউকে নেতা হতে দিতে চায় না।
২১। উন্নত বিশ্বে পুলিশ বাহিনী জনগণের আস্থার প্রতীক, জনগণের সেবক। আমাদের শিক্ষা এমন পুলিশ বাহিনী গঠন করেছে যে, পুলিশ নাম শুনলেই মানুষ ভয় পায়! আমাদের দেশের পুলিশ বাহিনী চরম ভাবে শুধুমাত্র দুর্নীতিগ্রস্তই নয় বরং যখন যে সরকার থাকে সেই সরকারের লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে কাজ করে!
২২। যে কোন দেশের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক খাত স্বাস্থ্যবিভাগ। আমাদের দেশে এ খাতটি অত্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত, লুটপাটের মুক্তবাজার এবং আস্থাহীনতায় ভুগছে! যার জন্য রাষ্ট্রের সকল দলের সকল শীর্ষ রাজনৈতিক নেতা, শীর্ষ আমলা, শীর্ষ ব্যবসায়ী, উচ্চবিত্তবানগণ, উচ্চ মধ্যবিত্তবানগণ কেহই এদেশে তাদের পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসা করায় না।
২৩। অসহায় নাগরিকদের শেষ আশ্রয়স্থল বিচারালয়। সেখানে দুর্নীতি আজ ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে পড়েছে।
২৪। দেশে অবকাঠামোসহ বেশ কিছু খাতে কিছু উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু এসব উন্নয়নের পেছনে যে পরিমাণে খরচ করতে হয়েছে তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল! এসব উন্নয়নের খরচ অন্যান্য দেশের তুলনায় শত শত গুণ এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে হাজার হাজার গুণ বেশি। তাছাড়া ওগুলোর মান অনেক নিম্ন!
২৫। দেশের শিক্ষা সৎ, দায়িত্বশীল, দেশপ্রেমিক, সেবাধর্মী ব্যবসায়ী সম্প্রদায় গড়ে তুলতে পারেনি। ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে প্রতিনিয়ত উৎপাদনকারী ও ভোক্তাকে অস্বাভাবিক ভাবে শোষণ করে চলেছে।
২৬। আমাদের শিক্ষা জ্ঞানগর্ভ, দায়িত্বশীল, ব্যক্তিত্ববান, অন্যায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ কন্ঠ বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, ইমাম, খতিব শ্রেণি গড়ে তুলতে পারেনি। অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, ইমাম, খতিব ও সুশীল সমাজ রাজনৈতিক দলের লেজুড়ে পরিনত হয়েছে। তারা হালুয়া রুটি ভাগাভাগি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
উপর্যুক্ত বিষয়াদি ব্যতিরেকেও আরো বহুবিধ অসামঞ্জস্যপূর্ণ কার্যক্রম আমাদের শিক্ষায় থাকার কারণে আমাদের আজ উন্নতির যেস্থানে অবস্থান করার কথা ছিল আমরা সেখানে পৌঁছতে পারিনি। এভাবে আর কতদিন? কোথায় আছে আমাদের সেই নেতা, যিনি আমাদেরকে মৌলিক বিষয় শিক্ষার মাধ্যমে শেকড় থেকে শিখরে পৌঁছে দেবেন।
লেখক: মোহাম্মদ ফজর আলী
সাবেক অধ্যক্ষ
ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ল্যাবরেটরি স্কুল এন্ড কলেজ।
ফোন: ০১৮১৯৪০৪৬০১