Thursday, June 1, 2023
spot_img
Homeসাহিত্যআবু আফজাল সালেহের শিল্পপ্রকরণ

আবু আফজাল সালেহের শিল্পপ্রকরণ

খায়রুল আলম রাজু

সাহিত্যের নানাবিধ রূপ বা প্রকার আছে। তারমধ্যে অন্যতম শাখা হলো ছড়া আর কবিতা। ছড়া বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম একটি শাখা। এটি মূলত স্বরবৃত্ত ছন্দে রচিত হয়ে থাকে। ছড়া হলো, ‘মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত ঝংকারময় পদ্য।’ কবিতা বা কাব্য হলো, শব্দ প্রয়োগের ছান্দসিক কিংবা অনিবার্য ভাবার্থের বাক্য বিন্যাস। ভাষাবিজ্ঞানি ও সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদের মতে, ‘যা পড়লে মনের ভিতর স্বপ্ন জেগে ওঠে, ছবি ভেসে ওঠে, তা-ই কবিতা।’

আবু আফজাল সালেহ একজন কবি, ছড়াকার এবং প্রাবন্ধিক। কবিতা আর ছড়া ছাড়াও তিনি প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনিসহ নানা গবেষণামূলক লেখার সৃষ্টিশীল ব্যক্তিত্ব। সৃজনশীলতা, কাব্যপ্রতিভা, শব্দের শৈল্পিকতাই তার লেখার শ্রেষ্ঠ উপাদান। শিশুদের জন্য নিবেদিত তার একমাত্র ছড়াগ্রন্থ ‘ছড়ায় ছড়ায় উৎসব’। বইটির প্রতিটি ছড়া, ছড়ার ভাষা, শব্দ এবং বিষয়বস্তু সবকিছুই শিশুতোষ। লেখনশৈলী, শব্দচয়ন, বাক্যগঠন নিটোল সুন্দর সাবলীল ও ঝরঝরে—ঠিক যেন ফুলের মতন।

বইটির চমৎকার কয়েকটি ছড়ার শিরোনামই যেন একেকটি ছড়ার সমতুল্য। তারমধ্যে নদীর ধারে পাখির বাসা, মায়ের ভাষা আমার ভাষা, রঙিন ঘুড়ি এবং খোকন সোনার বায়না অন্যতম। তাছাড়াও আছে দিল আনন্দে ভাসে, ফাগুন মাস, রবি তুমি ইচ্ছেখাতায়সহ ইচ্ছে জাগে একটি পাখির মতো চমৎকার শিরোনামের ছড়া। প্রকৃতির উপাদান নদী, গাছ, বন, পাখি, তরুলতা, কীটপতঙ্গ কত কী। তিনিও প্রকৃতির কবি। নদী ও প্রকৃতি তার ছড়ার অন্যতম উপাদান। আকাশে ভেসে ওড়া টুকরো মেঘের মতোই গতিশীল ছন্দে তিনি বুনতে থাকেন নদী ও প্রকৃতির কথা—সবুজ গাঁয়ের কথা, আঁকাবাঁকা মেঠোপথের দুপাশে বেড়ে ওঠা কচি সবুজ ঘাসফুলেদের কথা। যদি কয়েকটি ছড়ার তুলে ধরি, তাতেই ভেসে উঠবে সেসব কথার স্থিরচিত্র—
১. নদীর ধারে পাখির বাসা, চিল-শালিকে করে খেলা।
২. উঠোনজুড়ে পাখি মেলা মন ভরে কুজনে…
৩. চকচকে রোদ শুভ্র-সাদা মেঘ চলে যায় হেসে।
৪. বৃষ্টি পড়ে ঝিরঝিরিয়ে, টিনের চালে কলকলিয়ে…

প্রকৃতি ও নদী, নদী ও প্রকৃতি ঘুরেফিরে তার লেখার মুখ্য উপাদান। এমনই তো হওয়ার কথা। কবিরা ছন্দ খুঁজবে নদীর জলে, সবুজ ধানের শিশু চারা গাছে, দুলতে থাকা কলমি ফুলের গন্ধে—সুভাষিত বকুলের ও গোলাপের ঘ্রাণে। এখানে-ওখানে বেড়ে ওঠা পরগাছায়।

আবার ছড়ায় তিনি কখনো প্রকৃতিপ্রেমী, কখনো নজরুল ও রবি ভক্ত, কখনো আবার তিনি প্রতিবাদী। ভীষণ প্রতিবাদী! ভীষণ! নিচের ছড়াংশটি যেন তারই এক শ্রেষ্ঠ উদাহরণ—
দমে যায়নি তরুণ-সমাজ
বুলেট গান ব্যাঙ্কারে,
বাংলা ভাষা রাখতে উঁচু
ভয় পায়নি হুঙ্কারে…
(মায়ের ভাষা রাখতে উঁচু)

কবি নজরুলের মতো তিনিও যেন সুর তোলেন সাম্যের। ছন্দ বোনেন সম-অধিকারের। ছড়ার ছন্দে তাই কখনো যেমন তিনি প্রকৃতিপ্রেমী, ঠিক তেমনিভাবে তিনি আবার প্রতিবাদী, সাম্যবাদী ও পরাবাস্তববাদী। ছড়ায় এঁকেছেন বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, বিজয়ের আনন্দ, খুশির উল্লাস ভরা ছন্দকথা।

কবিতায়ও তিনি কাব্যপ্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। কবিতা যেন তার একেকটা ফুলের সৌরভ, চাঁদের জোছনা, ছেলেবেলার ছবি, লাউয়ের মাচায় ফিঙের নাচন, আমতলীর মেলা—কবিতার পঙক্তি, শব্দ ও বাক্য, উপমা আর অলংকরণে তিনি যেন নতুন এক সুকান্ত, ভিন্ন এক জীবনানন্দ কিংবা পল্লী কবির আধুনিক প্রতিভা! কবিতার পঙক্তিতে কখনো তিনি সাহসী, অকুতোভয়, বীর; আবার কখনো তিনি সহজ-সরল, সাদামাটা, নদীর মতো বহমান, শিশুর মতো শান্ত, বাঁশগাছের মতো স্থির—পরক্ষণেই যেন আগুনের লেলিহান দাবানলের মতো ভয়ংকর।

এসব কথার উদাহরণ লেখার আগে কেমন তার কবিতা তা-ও বলছি না। কাব্যগ্রন্থের নামকরণ বলে তিনি প্রেমিক। সব কিছুর শুরু ও শেষে তিনি সত্যিই প্রেমিক। ‘বারবার ফিরে আসি’ ও ‘বলেই ফেলি ভালোবাসি’ বই দুটো যেন তা-ই বলে। কথাটির সত্যতার জন্য লেখকের কয়েকটি কবিতার শিরোনাম পড়া যেতে পারে। নামকরণের মাধ্যমেই যেন ভেসে ওঠে প্রেমিক হওয়ার সার্থকতা। যেমন-
১. হয়তো প্রেমে পড়েছিলাম
২. তোমার চিঠি
৩. বিজয়ী চুম্বন
৪. নিস্তব্ধ হয়ে যাচ্ছি তোমাকে না পেয়ে।
হাসি-দুঃখ, বেদনা-হাহাকার, প্রেম-প্রকৃতি, প্রতিবাদ-সরলতা সব কিছুর সংমিশ্রণে সেজেগুজে ওঠে তার একেকটি কবিতা—কবিতার পঙক্তি।

মাটি ও মানুষ, আন্দোলন-সংগ্রাম, নদী ও প্রকৃতি, গ্রাম ও শহর, লোকজ উপাদানে ভরপুর তার কাব্য। এজন্যই হয়তো বিজ্ঞজন সাহিত্যচর্চাকে শিল্প ও সাহিত্য নামে দুটো ভাগ করেছেন। সাহিত্য ও শিল্প আলাদা। সাহিত্য সবাই সৃষ্টি করলেও শিল্প গড়ে তোলা বড্ড কঠিন বটে। সেই কঠিন ও জটিলতা পেরিয়ে শিল্প ও সাহিত্য কিংবা সাহিত্য ও শিল্প তৈরিতে তিনি যেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তার কলম, কবিতার শব্দ, নান্দনিক উপমা, বাক্যগঠন, কবিতা সাজিয়ে তোলার ধৈর্য সব কিছু তার আছে। এজন্য তাকে আমি প্রকৃতি ও প্রেমের কবি, ঋতু ও সাম্যের কবি, পরাবাস্তববাদী ও প্রতিবাদী কবি বলেই সম্বোধন করছি।

নিচের পঙক্তিমালা, শব্দ ও উপমা জানান দেয় তিনি সাহসী ও বীর। বলে দেয় তিনি স্বাধীনতার পক্ষের এক যুক্তিবাদী কবি।
১. মানচিত্র ছিঁড়ে খেতে চায় শকুনেরা!
২. এজিদ-মীরজাফর একটি গালিমাত্র।
৩. সাতটি রং, পাই একটি কবিতার খোঁজ
দেশ ও দশের কথা, প্রেয়সী ও নদীর কথা, মাটি ও সরলতার ভাষা, প্রকৃতি আর প্রতিবাদ যেন ফুটে ওঠে নিচের কবিতাবলির নামকরণে—
১. প্রজাপতি মানুষের গল্প
২. আমি একটি সমুদ্র হতে চেয়েছিলাম
৩. শ্রেষ্ঠতম বন্ধু
৪. লোভীদের ভুলে স্বপ্ন ভাঙে বারবার।

তার লেখার উপকরণ প্রকৃতি। বাক্য ও ভাষা সাবলীল—ঝরঝরে। উপমা ও শব্দচয়ন তুলনাহীন। কবিতার পঙক্তি যেন শক্তিশালী বড় ইমারত, উঁচু দণ্ডায়মান পাহাড় কিংবা সুবিশাল আকাশ।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, শিশুতোষ পত্রিকা শিশুটামি।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments