সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় স্পেস সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থী নাহিয়ান আল রহমান তৈরি করেছেন রকেট। পরীক্ষামূলক উড্ডয়নও হয়েছে কয়েকবার। আবহাওয়াসংক্রান্ত গবেষণার কাজে তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে তাঁর রকেট। বিস্তারিত জানাচ্ছেন নিয়ামুল কবীর সজল
ছোটবেলা থেকেই আবিষ্কারের নেশায় পেয়েছিল গাইবান্ধার তরুণ নাহিয়ান আল রহমানের। স্বপ্নের পরিধিটা আরো বাড়ে ২০১১-১২ সেশনে ময়মনসিংহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তির পর। এই কলেজে তিনি ভর্তি হন ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস বিভাগে। চেষ্টা শুরু করেন রকেট তৈরিতে।
ব্যর্থও হয়েছেন
নাহিয়ান জানান, রকেট তৈরিতে অনেক খরচ হয়। তাই তাঁরা চেষ্টা করেন ওয়াটার রকেট তৈরিতে। এতে তাঁরা সফল হন।
এদিকে নাহিয়ানের ময়মনসিংহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের পাঠ চুকে যায় ২০১৭ সালে। এখন তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভিয়েশন অ্যান্ড এরোস্পেস ইউনিভার্সিটিতে স্পেস সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ের মাস্টার্স শেষ সেমিস্টারের ছাত্র।
ধূমকেতু এক্স
২০১৮ সালের শেষ দিকে এবং ২০১৯ সালের শুরুর দিকে নাহিয়ানদের টিম একটি ইলেকট্রিক উড়োজাহাজ তৈরির চেষ্টা করে। ৬০ শতাংশ কাজ করার পর আর্থিক সংকটে এই কাজ তাঁরা শেষ করতে পারেননি। তখন তাঁরা আবার রকেট তৈরির দিকে মনোযোগ দেন। তখনই গড়ে ওঠে ১৫ সদস্যের ধূমকেতু এক্স। এঁদের মধ্যে থেকে অনেকেই সার্বক্ষণিকভাবে কাজ করেছেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন সাইদুর রহমান, নাদিম আহমেদ, লিয়ান মল্লিক, শাহরুখ খান, আদিল আরহাম, আবরার ফয়সাল, ফজলে রাব্বী, জান্নাতুল নাঈম ও আশরাফ মিয়া। অবশেষে টানা চার বছরের পরিশ্রমে তৈরি হয় তাঁর কাঙ্ক্ষিত রকেট। রকেট তৈরি করতে গিয়ে সবচেয়ে কঠিন অবস্থায় পড়তে হয়েছে অর্থসংকটের কারণে। পরিবারের কাছ থেকে তিনি অর্থ নেন। ব্যাংক থেকে ঋণ করেন। এমনকি খরচ করেন নিজের টিউশনির টাকাও।
অবশেষে ২০২১ সালের শেষের দিকে নাহিয়ান এবং তাঁর দল সক্ষম হয় রকেট তৈরিতে। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে তাঁরা রকেটটি উেক্ষপণের জন্য জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আবেদন করেন। কিন্তু দীর্ঘদিনেও কোনো অনুমতি না পেলে দলের মনোবল ভেঙে যায়। দলের তিনজন বিদেশে বিভিন্ন স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার জন্য চলে যান। রকেট নিয়ে তাঁরা অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ দেখতে পান।
রকেটের নাম একুশ আর ধূমকেতু
দল হতাশ হয়ে গেলেও নাহিয়ান কিন্তু লেগে ছিলেন। অবশেষে ফল পেলেন ‘রকেট্রি ইনোভেশন চ্যালেঞ্জ’-এর মাধ্যমে। ২০২২ সালের নভেম্বরে আইসিটি মন্ত্রণালয়ের এটুআই প্রজেক্ট আয়োজিত রকেট্রি চ্যালেঞ্জে ১২৪টি দলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়ে ‘ধূমকেতু এক্স’ লাভ করে ৫০ লাখ টাকার অনুদান। এই অর্থের চার ভাগের এক ভাগ টাকা তাঁরা এরই মধ্যে পেয়েছেন, যার মাধ্যমে তৈরি হয়েছে ধূমকেতু ১, ২, ৩, ৪ এবং রকেট একুশে। আর ২০২৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারিতে ধূমকেতু এক্স টিম বেসরকারিভাবে দেশের প্রথম সফল সাউন্ডিং রকেট টেস্ট সম্পন্ন করে, যার নাম ছিল ‘ধূমকেতু ০.০১’ (পুঁটি মাছ)। সেটির রেঞ্জ ছিল এক কিলোমিটার।
২০২৩ সালের নভেম্বরে ময়মনসিংহ শহরের টাউন হল মাঠে ‘একুশে-০১’ রকেটটি তাঁরা প্রদর্শনও করেন। ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের মেয়র এবং ধূমকেতু এক্সের উপদেষ্টা ইকরামুল হক টিটু এটি উন্মোচন করেন। এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন মালয়েশিয়ার সানওয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যানো উপকরণ ও শক্তি প্রযুক্তি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সাইদুর রহমান, নাসা অ্যাপস চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশের উপদেষ্টা আরিফুল হাসান অপু, এটুআই কর্মকর্তা জ্যোতির্ময় সিনহা, মোহাম্মদ শাহজালাল, বাংলাদেশ ট্যুরিজম ফাউন্ডেশনের সভাপতি মোখলেছুর রহমান এবং ধূমকেতুর উপদেষ্টা সিটি ল্যাব লিমিটেডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর এম এ ওয়ারেছ বাবু।
রকেট একুশের ওজন ৪৫ কেজি। লম্বায় ১২ ফুট। ব্যাস সাড়ে ছয় ইঞ্চি। এটিকে সাউন্ডিং রকেটও বলা হয়। সাউন্ডিং রকেট হলো এক বা দুই পর্যায়ের প্রপেলান্ট রকেট, যা উচ্চ বায়ুমণ্ডলীয় অঞ্চল অনুসন্ধান এবং মহাকাশ গবেষণার জন্য ব্যবহৃত হয়। রকেট একুশের মাধ্যমে মূলত আবহাওয়ার বার্তা পাওয়া যাবে। নাহিয়ান আল রহমান জানান, বাংলাদেশে রকেট উেক্ষপণের নীতিমালা না থাকায় রকেটটি তৈরির পর জটিলতায় পড়তে হয়। এখন সরকারিভাবে রকেট উেক্ষপণের অনুমতি মিলেছে। ধূমকেতু ১, ২, ৩, ৪ ও একুশে-০১-এর পরের ধাপে বায়ান্ন ও একাত্তর রকেট তৈরি করা হবে। একটি রকেট তৈরি করতে ছয় মাস থেকে এক বছর সময় লেগে যায়।
এ মাসের শেষ দিকে অথবা মার্চ মাসের প্রথম দিকে ধূমকেতু ১, ২, ৩, ৪ একুশে-০১ উেক্ষপণ করা হবে। ইনস্ট্যান্ট ডাটা কমিউনিকেশনের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে প্যারাসুটের মাধ্যমে রকেটটি পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা হবে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত পত্রিকা ‘ধূমকেতু’র সঙ্গে মিলিয়ে রকেটগুলোর নাম রাখা হয়েছে। মোট চারটি রকেট তৈরি করা হয়েছে এই নামে। ধূমকেতু ১ ও ২ লম্বায় সাত ফুট এবং ডায়ামিটার ৩.৫ ইঞ্চি। অন্যদিকে ধূমকেতু ৩ ও ৪-এর উচ্চতা ও ডায়ামিটার যথাক্রমে আট ফুট এবং ১০ ফুট ও ৪.৫ ইঞ্চি। অন্যদিকে একুশে-০১ রকেট লম্বায় ১২ ফুট এবং ডায়ামিটার ছয় ইঞ্চি। বর্তমানে রকেট বায়ান্ন তৈরির কাজ চলছে। তিন মাসের মধ্যে এর কাজ তাঁরা শেষ করতে পারবেন।