রাজধানীর তেজগাঁওয়ে মেয়র আনিসুল হক সড়ক। সাতরাস্তা থেকে তেজগাঁও রেললাইন পর্যন্ত এই সড়কটি এক সময় পুরোটাই দখল করে গড়ে উঠেছিল ট্রাকস্ট্যান্ড। সড়ক থেকে স্ট্যান্ড উচ্ছেদ করে নিজের স্বপ্নের মতো সাজিয়ে ছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র আনিসুল হক। এজন্য তাকে অনেক বেগ পেতে হয়। নিতে হয় জীবনের ঝুঁকি। অনেক চেষ্টায় সড়কটিকে উদ্ধার করে সাজিয়ে ছিলেন দৃষ্টিনন্দন করে। প্রয়াত মেয়রের সেই স্বপ্নের সড়কটি এখন আর তার রেখে যাওয়া সড়কের মতো নেই। আনিসুল হকের শূন্যতায় সেই সড়ক দখল করে গড়ে উঠেছে আবার ট্রাকস্ট্যান্ড। এখন মূল সড়কের ওপর রাখা হচ্ছে সারি সারি ট্রাক, কাভার্ডভ্যান। সড়কের দুই পাশে কোথাও এক লাইন, কোথাও দুই লাইনে পার্কিং করে রাখা হচ্ছে ভারী যানবাহন।
প্রায় ১০০ ফুট চওড়া এই সড়ক দখল হয়ে যাওয়ায় যানবাহন চলাচল অসম্ভব হয়ে পড়ছে। ফলে এই সড়কে প্রতিদিনই ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে থাকে যানজট। ঘটছে নানারকম দুর্ঘটনা।
শুধু সড়ক নয়, দখল হয়েছে ফুটপাথও। ট্রাক, কাভার্ডভ্যানের ব্যাক সাইট ফুটপাথের ওপর তুলে রাখায় পথচারীরা বিপাকে। কোথাও কোথাও ফুটপাথে গাড়ি রেখে পথচারীদের চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এছাড়া এখানে সন্ধ্যা নামলেই বেড়ে যায় নানা অপকর্ম। ট্রাক-কাভার্ডভ্যানের আশেপাশে ও নিচের ফাঁকা স্থানে বসে মাদকের আসর। অনেক সময় তাদের হামলার শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। প্রায়ই পথচারী ও রিকশা, সিএনজি যাত্রীদের গতিরোধ করে ছিনিয়ে নিচ্ছে টাকা-পয়সা, মোবাইলসহ সঙ্গে থাকা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। ঢাকা উত্তরে বিভিন্ন এলাকায় সিটি করপোরেশন উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করলেও কোনো অদৃশ্য শক্তির কারণে মেয়র আনিসুল হক সড়কে উচ্ছেদ অভিযান হচ্ছে না। যদিও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বর্তমান মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম একাধিকবার এই সড়কটি পরিদর্শন করেছেন।
জানা যায়, সাতরাস্তা থেকে রেললাইন পর্যন্ত সড়কে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা বহু বছরের ট্রাকস্ট্যান্ডটি ২০১৫ সালে উচ্ছেদ করেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আনিসুল হক। যে কারণে সে সময় বিক্ষুব্ধ চালক ও শ্রমিকদের ক্ষোভের মুখে পড়েন তিনি। হতে হয় অবরুদ্ধ। তখন দখলদারদের ইটপাটকেল আর পুলিশের টিয়ারশেলের মধ্য দিয়ে সড়কটিকে ‘পার্কিংমুক্ত’ করে সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করেন তিনি। পরে রাস্তাটির সংস্কার করে আরও প্রশস্ত করেন। তার সময়ে ঢাকার সবচাইতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সড়ক হিসেবে এটিকেই বিবেচনা করা হতো। আনিসুল হকের মৃত্যুর পর থেকে ফের দখলদারদের হাতে চলে যায় সড়কটি। অথচ মেয়র আনিসুল হক সড়ক দিয়ে প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ যাতায়াত করছেন। এই পথেই ফার্মগেট ও কারওয়ান বাজার থেকে সাতরাস্তা হয়ে তেজগাঁও মহাখালী, বনানী, গুলশান, নিকেতনে হাজার হাজার যানবাহন চলাচল করছে। অন্তত ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, কয়েকটি গণমাধ্যমসহ বহু সরকারি- বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা এই সড়ক ব্যবহার করছেন। সড়কটি দখল হয়ে যাওয়ায় প্রতিনিয়ত চলাচলে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের।
সরজমিন দেখা যায়, ভূমি ও জরিপ অধিদপ্তরের সামনের সড়কজুড়ে রাখা হয়েছে ট্রাক। মেয়র আনিসুল হক সড়কের দুই পাশেই সারি সারি রাখা হয়েছে ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান। কোথাও চলছে ট্রাক মেরামতের কাজ। যন্ত্রাংশ খুলে রাখা হয়েছে প্রধান সড়কে, কোথাও আবার ফুটপাথে। মদিনা মসজিদ সংলগ্ন এলাকায় এলোমেলো করে রাখা হয়েছে কাভার্ডভ্যান। সেখানে শ্রমিকরা অনেকেই এসব গাড়ির যন্ত্রাংশ খুলে কাজ করছেন। সড়কের মসজিদ মার্কেটের সামনে দিয়ে উত্তরদিকের সড়কটি পুরোপুরি দখলে চলে গেছে বিকল হয়ে যাওয়া ট্রাক মেরামতকারীদের। সেখানে চলছে নতুন ট্রাক ও কাভার্ডভ্যানের বডি সংযোজনের কাজ। বিভিন্ন দুর্ঘটনার শিকার হওয়া যানবাহনের ইঞ্জিন মেরামতের কাজ চলছে।
এছাড়া সিএসডি গুদামের ২ নম্বর গেট, বিজি প্রেস স্টাফ কোয়ার্টার, সিএসডি ভাঙা গেট মোড় হয়ে পুরনো এফডিসি সড়কের পুরোটাই ট্রাক, পিকআপ ও ছোট ট্রাকগুলো রাখা হয়েছে। গত রোববার রাতে সরজমিন দেখা যায়, পুরো সড়কটি দখল করে রাখা হয়েছে ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান। সড়কে আড়াআড়িভাবে ট্রাক পার্কিং করে রাখায় প্রাইভেটকার কিংবা রিকশা যাওয়ার জায়গা নেই। এতে লেগে যায় যানজট। প্রায় ঘণ্টাব্যাপী যানজট থাকলেও সেখানে থেকে সরানো হয়নি কোনো ট্রাক। মো. সালাহউদ্দিন নামের নামের একজন ট্রাকচালক জানান, আনিসুল হক মারা যাওয়ার পর থেকেই সড়কটিতে গাড়ি রাখছেন তারা। ট্রাক ভাড়া না হলে এই সড়কেই সবাই পার্কিং করে রাখেন। গাড়ির কাজ থাকলেও এখানেই সারানো হয়। গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য সব সময়ই আমাদের কাছ থেকে বিভিন্ন সংগঠনের নামে চাঁদা নেয়া হয়। পুলিশ মাঝে-মধ্যে সড়ক থেকে গাড়ি সরানোর চেষ্টা করলেও নেতারা ওসব ম্যানেজ করেন। মদিনা মসজিদ সংলগ্ন সড়কে ট্রাক মেরামতকারী কয়েকজন জানান, আমাদের এখানে জায়গা না থাকায় সড়কে গাড়ি রেখেই কাজ করতে হচ্ছে। সড়কে গাড়ির যন্ত্রাংশ রাখা হয়েছে।
অনেক সময় কাজ করতে গিয়ে রাস্তা নষ্ট হয়ে যায়। মানুষ হাঁটাচলা করার সময় গালমন্দ করেন। বিজি প্রেস, স্টাফ কোয়ার্টারের সামনে গাড়ি পরিষ্কার করছিলেন ফাহিম নামের এক শ্রমিক। তিনি বলেন, গত এক সপ্তাহ ধরে এখানেই গাড়ি রাখা ছিল। আশপাশে যত ছোট-বড় ট্রাক আসে, তার বেশির ভাগই এখানে রাখা হয়। অনেকে মাসের পর মাস গাড়ি রাখছেন। ট্রাকস্ট্যান্ডের জন্য জায়গা না থাকায় এখানেই পার্কিং করতে হয়। মাঝেমধ্যে পুলিশ এসে ধাওয়া করে। তখন সবাই ট্রাক নিয়ে চলে যান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শ্রমিক নেতা জানান, তেজগাঁও এলাকায় অন্তত ৩ হাজার ট্রাক-কভার্ডভ্যান রয়েছে। যা কাওরান বাজার ও তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রির মালামাল লোড-আনলোড করা হয়। দীর্ঘদিন যে স্থানটি ট্রাকস্ট্যান্ড হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, সেখানে ৩০০/৪০০ ট্রাক-কভার্ডভ্যানও ধারণক্ষমতা নেই। সেই সুযোগে প্রভাবশালী ট্রাকমালিকরা ও ইউনিয়নের নেতারা সচল সড়কের ওপর ট্রাক-কভার্ডভ্যান রাখছেন। প্রতিদিন প্রায় আড়াই হাজার ট্রাক-কাভার্ডভ্যান সড়কের ওপর রাখা হচ্ছে। এতে প্রশস্ত রাস্তাও সরু হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া অনেক সময় দিনের বেলায় গাড়ি লোড কিংবা আনলোড করা যায় না। রাতে করতে হয় এসব কাজ। আবার অনেকদিন এসব গাড়িকে বসে থাকতে হয়। এতে পার্কিংয়ের জায়গা লাগে।
ফলে শ্রমিকরা কোথাও জায়গা না পেয়ে মেয়র আনিসুল হক সড়কে গাড়ি রাখেন। মালিক ও শ্রমিকদের বিভিন্ন সংগঠন যে পরিমাণে চাঁদা আদায় করে, তা দিয়ে একটা নিদিষ্ট এলাকায় ট্রাকস্ট্যান্ড ও পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
বাংলাদেশ আন্তঃজেলা ট্রাকচালক ইউনিয়নের সভাপতি তাজুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, প্রতিদিন হাজার হাজার ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালামাল নিয়ে ঢাকায় ঢুকছে। মালামাল লোড-আনলোডের জন্য মাঝেমধ্যে সড়কে ট্রাক থাকে। এছাড়া এখন এই খাতের ব্যবসা মন্দা যাচ্ছে। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে মালিক-শ্রমিকরা ট্রাক ভাড়া দিতে না পারায় ট্রাক সরাতে চাচ্ছে না। কিছু কিছু ট্রাক আছে যা মাসের পর মাস বসে আছে। মেয়র আনিসুল হক এই সড়ক থেকে ট্রাক-কাভার্ডভ্যান উচ্ছেদের পর থেকে আমরাও চাই না জায়গাটা আগের অবস্থায় থাকুক। এছাড়া ট্রাকস্ট্যান্ডের জন্য নির্দিষ্ট কোনো জায়গা নেই। যেটা আছে, তাও রেলওয়ের জায়গা। ট্রাকস্ট্যান্ডের জন্য অন্যদিকে জায়গা খোঁজা হচ্ছে। জায়গা পেলেই ট্রাকগুলো সরিয়ে নেয়া হবে। সড়ক ছেড়ে দেয়া হবে।
এদিকে সড়ক ও ফুটপাথের দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। সংস্থাটির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা ড. মোহাম্মদ মাহে আলম মানবজমিনকে বলেন, মেয়র আনিসুল হক সড়ক দখল হওয়া নিয়ে অবগত আছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। উচ্ছেদের চেষ্টা আছে। তবে কাজটি প্রধান সম্পত্তি বিভাগের হলেও প্রকৌশল বিভাগকে উচ্ছেদের বিষয়ে বলা হয়েছে। মেয়র আনিসুল হক সড়কটি দখলমুক্ত হচ্ছে না কেন তারাই বলতে পারবে।