Sunday, March 26, 2023
spot_img
Homeবিজ্ঞান ও প্রযুক্তিঅ্যাপে গৃহকর্মী সেবা

অ্যাপে গৃহকর্মী সেবা

ঢাকায় বসবাস করেন কিন্তু কাজের বুয়া নিয়ে ভোগান্তিতে পড়েননি এমন মানুষের সংখ্যা যৎসামান্য বলা যেতে পারে। ঠিক একই ধরনের ভোগান্তি থেকে ২০১৭ সালে মাহমুদুল হাসান লিখন ও মেহেদী স্মরণ দুই ভাই মিলে এক উদ্যোগ শুরু করেন। তাঁদের সেই প্রচেষ্টার নামই হলো ‘হ্যালোটাস্ক’। এটি মূলত একটি অন ডিমান্ড গৃহকর্মী খোঁজার প্ল্যাটফরম।

অ্যাপটি ব্যবহার করে দৈনিক বা মাসিক ঘণ্টা ভিত্তিতে গৃহকর্মী ডেকে বাসাবাড়ির নানা কাজ করানো যায়। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে উদ্যোগটি সম্প্রতি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কম্পানি স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেডের বিনিয়োগ পেয়েছে। এর আগেও তাঁরা সিঙ্গারপুরভিত্তিক প্রতিষ্ঠান থেকে ও দেশীয় বিনিয়োগ পেয়েছেন।

শুরুর গল্প

হ্যালোটাস্কের সহপ্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান নির্বাহী মাহমুদুল হাসান লিখন বলেন, ‘আমাদের বাসায় যে গৃহকর্মী ছিলেন, তিনি নানা অজুহাতে কাজে আসতেন না। তখন মনে হয়েছিল এটা শুধু আমার না, ঢাকা শহরের বেশির ভাগ বাসার গল্প। তাই এই যে বাস্তব একটি সমস্যা, এটিকে সমাধান করা গেলে এখানে অনেক বড় বাজার তৈরি করা সম্ভব। ’ সেই চিন্তা থেকেই হ্যালোটাস্কের কাজ শুরু করেন তাঁরা।

যেভাবে সেবাটি নেওয়া যাবে

হ্যালোটাস্ক থেকে গৃহকর্মী সেবা পেতে হ্যালোটাস্কের মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন কিংবা ওয়েবসাইটে যেতে হবে। তারপর একটি অ্যাকাউন্ট খুলে ম্যাপে বাড়ির ঠিকানা যুক্ত করলে সেই এলাকায় সেবা দেওয়ার মতো কোনো বুয়া থাকলে সেটি প্রদর্শিত হবে। এরপর নির্দিষ্ট প্যাকেজ মোতাবেক বুয়া নিশ্চিত করলে পূর্বনির্ধারিত সময় অনুযায়ী বাসায় নির্দিষ্ট গৃহকর্মী পৌঁছে যাবে। তাদের প্ল্যাটফরমে থাকা প্রত্যেক গৃহকর্মী ফ্রিল্যান্স ভিত্তিতে কাজ করে থাকেন। তাঁরা কেউই নির্দিষ্ট বেতনভুক্ত নন।

তবে তাঁদের অ্যাপের মাধ্যমে দৈনিক কয়েক ঘণ্টা কাজ করে মাসিক ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয়ের সুযোগ রয়েছে।

মাহমুদুল হাসান বলেন, তাঁদের প্ল্যাটফরম থেকে বর্তমানে প্রতি কর্মী মাসিক গড়ে ১০-১২ হাজার টাকা আয় করেন।

সেবার ধরন ও চার্জ

তাঁদের অ্যাপে কয়েকটি ক্যাটাগরিতে গৃহকর্মী পাওয়া যায়। গৃহকর্মীর কাজের ধরন ও এলাকাভেদে তাঁদের সেবার মূল্যের পার্থক্য হয়ে থাকে। তাঁদের যেমন ইনস্ট্যান্ট সার্ভিস প্যাকেজ রয়েছে, ঠিক তেমনি সাপ্তাহিক কিংবা মাসিক প্যাকেজ রয়েছে।

ঘণ্টাপ্রতি সর্বনিম্ন ৫৯ টাকা ও মাসিক সর্বনিম্ন ৮০০ (এক কাজ) টাকা থেকে তাঁদের প্যাকেজ শুরু। ঘণ্টার প্যাকেজে সর্বনিম্ন ২ ঘণ্টার জন্য সার্ভিস বুকিং করা যাবে। আর মাসিক প্যাকেজে (২৬ দিন) সর্বনিম্ন দুই কাজের জন্য সার্ভিস বুকিং করা যাবে। দৈনিক প্যাকেজে সার্ভিস চার্জ যুক্ত হবে ১০০ টাকা প্রতি অর্ডারে, আর মাসিক প্যাকেজে ১৫ শতাংশ হারে। তবে এই কমিশনটি তাঁরা সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে নিয়ে থাকেন, সেবা প্রদানকারীদের (কর্মীদের) থেকে নয়। তাঁদের প্যাকেজগুলোর বিস্তারিত ওয়েবসাইটেও পাওয়া যাবে।

নিরাপত্তা

বাসায় অপরিচিত গৃহকর্মী নিয়োগ করে অনেক সময় চুরি থেকে শুরু করে অন্যান্য নিরাপত্তাজনিত দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়। কিন্তু হ্যালোটাস্ক থেকে সেবার ক্ষেত্রে এই ধরনের ঝুঁকি নেই বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা। কেননা তাঁদের অ্যাপে নিবন্ধিত সব বুয়া ভেরিফায়েড। নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রত্যেকের জাতীয় পরিচয়পত্র, অন্যান্য নথিপত্র এবং স্থানীয় কমপক্ষে দুজন অভিভাবকের তথ্য তাঁরা সংরক্ষণ করে থাকেন। ফলে যদি কখনো এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে যায়, সে ক্ষেত্রে সহজেই আইনি পদক্ষেপ নেওয়া যায়। এ ছাড়া তাঁদের প্রতিটা সেবা ইনস্যুরেন্স সেবার আওতাধীন। ফলে তাঁদের কোনো কর্মী কোনো বাসায় কাজ করার সময় কিছু ভেঙে গেলে কিংবা কোনো ক্ষতি হলে সেবাগ্রহীতা সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ পাবেন, যার সর্বোচ্চ পরিমাণ হতে পারে ২০ হাজার টাকা।

বর্তমান হাল ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

বর্তমানে ঢাকা শহরের প্রায় ৮০ শতাংশ এলাকা তাঁদের সেবার আওতাধীন। প্রায় ৩০০-এর মতো নিবন্ধিত কর্মী নিয়মিত ভিত্তিতে সেবা দিয়ে থাকেন। এলাকা ও কর্মীসংখ্যা বৃদ্ধিতে প্রতিনিয়িত মানোন্নয়নের কাজ করে যাচ্ছেন তাঁরা। বর্তমানে ধানমণ্ডি ও মোহাম্মদপুরের পাশাপাশি মিরপুর, কল্যাণপুর, আগারগাঁও, উত্তরা, গুলশান, বনানী, মহাখালী, বসুন্ধরা, বারিধারা, বাড্ডা, রামপুরা, বনশ্রী, মালিবাগ, মগবাজার, খিলগাঁও, বাসাবো, কমলাপুর এলাকায় অন ডিমান্ড গৃহকর্মী দিচ্ছে হ্যালোট্যাস্ক।

এখন পর্যন্ত ঢাকায় তাঁরা তিন লাখের অধিক অর্ডার সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন। উল্লেখ্য, করোনাকালে তাঁদের সেবা প্রায় এক বছর বন্ধ ছিল।   সব সার্ভিস রিকুয়েস্ট তাঁরা সার্ভ করতে পারছেন না। এ বিষয়ে হাসান জানিয়েছেন, তাঁরা বর্তমানে কাজ করছেন একেবারে হাইপারলোকাল পদ্ধতিতে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, ঢাকার বুয়ারা সাধারণত নিজের এলাকায়ই কাজ করে থাকেন। যেমন—ডিওএইচএসের কোনো কর্মী ডিওএইচএসের ভেতরেই কাজ করেন, তিনি পার্শ্ববর্তী এলাকা মিরপুর ১১, ১২, পল্লবীতে কাজে আগ্রহী নন। কিংবা যাতায়াতজনিত ঝামেলার কারণেও পার্শ্ববর্তী এলাকাতে গিয়ে কাজ করার প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এ জন্য অনেক সময় অনেক এলাকা থেকে সার্ভিস রিকুয়েস্ট এলেও সেটি তাঁরা সার্ভ করতে পারছেন না।

সমস্যাটি নিরসনে কাজ করছেন তাঁরা। সমস্যাটি সমাধানে প্রতি এলাকাভিত্তিক আরো অধিকসংখ্যক কর্মী তাঁদের প্ল্যাটফরমে যুক্ত করার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এ বছরে ঢাকার প্রায় বেশির ভাগ এলাকা তাঁদের সেবার আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা রয়েছে। ঢাকায় পরিপূর্ণ সেবা চালুর পর বিভাগীয় শহরগুলোতেও তাঁদের সেবা চালুর পরিকল্পনা রয়েছে।

‘কম্পিউটার আপা’-প্রযুক্তি

হ্যালোটাস্কের সেবাটি চালিয়ে নিতে এ পর্যন্ত নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ ও প্রতিবন্ধক পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে তাঁদের। যেমন—সেবাগ্রহীতা অ্যাপের মাধ্যমে বুকিং করলেও যেহেতু বেশির ভাগ বুয়া স্মার্টফোন ব্যবহারে অপারগ কিংবা খুব একটা সাবলীল নয়, তাই বুয়াদের সঙ্গে যোগাযোগ হ্যালোটাস্কের পক্ষ থেকে ম্যানুয়ালি করা হতো আগে। এটি তাঁদের সার্ভিস অপারেশনে অন্যতম বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল রিয়েল টাইম সার্ভিস প্রদানের ক্ষেত্রে।

সমস্যাটির সমাধান কিভাবে করলেন? প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী মাহমুদুল হাসান এ প্রসঙ্গে বললেন, তাঁরা কম্পিউটার আপা নামে নতুন একটা প্রযুক্তি তৈরি করেছেন, যা ব্যবহার করে ফিচার ফোন দিয়েও তাঁদের কর্মীরা রিয়াল টাইম সার্ভিসের রিকুয়েস্ট গ্রহণ করতে পারেন।

বর্তমানে প্রযুক্তিটি প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, এটির মানোন্নয়নে তাঁরা কাজ করে যাচ্ছেন। পরবর্তী সময়ে এটি ব্যবহার করে তাঁদের সেবার পরিধি আরো বৃহৎ করা সম্ভব বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তাঁরা।

কর্মীদের প্রশিক্ষণ

ভবিষ্যতে আরো বেশিসংখ্যক গৃহকর্মীকে তাঁদের প্ল্যাটফরমে যুক্ত করতে চান তাঁরা। এ জন্য দুটি এনজিও ব্র্যাক ও অক্সফামের সঙ্গে কাজ করছেন তাঁরা। অক্সফামের অর্থায়নে ‘সুনীতি’ নামে একটা প্রকল্প করা হয়েছে, যেখানে প্রায় ৭৫ কোটি টাকার প্রকল্পের মাধ্যমে ১৬ হাজার গৃহকর্মীকে বিশেষ প্রশিক্ষণ, সার্টিফিকেশন এবং হ্যালোটাস্কের মাধ্যমে জব প্লেসমেন্ট করা হবে। এখানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আওতাধীন ‘জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’ (NSDA) গৃহকর্মীদের সার্টিফাই করছে।

এ ব্যাপারে অক্সফামের প্রকল্প সমন্বয়ক গীতা অধিকারী বলেন, ‘গৃহকর্মীদের জীবনমান এবং কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি করে ফরমাল কেয়ার ইকোনমিতে সংযুক্ত করা এবং তাঁদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া এই প্রকল্পের লক্ষ্য। ’

যুক্ত হবেন বিদেশফেরত গৃহকর্মীও

দেশ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে গৃহকর্মী হিসেবে অনেক নারী মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যাচ্ছেন। অনেকে সেখানে ভালোভাবে কাজ করতে পারলেও অনেকের ক্ষেত্রে নির্যাতিত হয়ে দেশে ফেরত আসার মতো ঘটনাও ঘটেছে। এই ধরনের নারীদের নিয়ে কাজ করতে চায় হ্যালোটাস্ক।

এ জন্য ব্র্যাকের একটি প্রকল্পের আওতায় তারা যৌথভাবে প্রয়াস চালাচ্ছে।

এ বিষয়ে মাহমুদুল হাসান জানান, বিদেশফেরত গৃহকর্মীরা দেশে এসে এ ধরনের কাজে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অনাগ্রহী।

তবে তাঁরা ব্র্যাকের সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালাচ্ছেন এই ধরনের কর্মীদের যুক্ত করার ব্যাপারে।

পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে তুলে আনা সম্ভব

দেশে শহরাঞ্চলগুলোতে একদিকে যেমন তীব্র গৃহকর্মী সংকট, আর অন্যদিকে একটা বিশাল অংশের জনগোষ্ঠী নিম্ন আয়ের। হ্যালোটাস্কের মাধ্যমে এই সমস্যা সমাধানে চমৎকার ভূমিকা রাখা সম্ভব। বৃহৎ পরিসরে প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে এই জনগোষ্ঠীর মানুষকে কাজে যুক্ত করার মাধ্যমে একদিকে যেমন তাঁদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করে তোলা সম্ভব, অন্যদিক গৃহকর্মী সংকট সমস্যাও মোকাবেলা করা সম্ভব।

হতে পারে প্যাসিভ ইনকামের মাধ্যম

ঢাকায় নিম্ন বা মধ্যম আয়ের মানুষের সংখ্যা অনেক। অ্যাপটি এমন মানুষের জন্য অতিরিক্ত আয়ের একটি মাধ্যমও হয়ে উঠতে পারে। যেমন—একজন গার্মেন্টকর্মী তাঁর চাকরির বাইরে যে অবসর সময় পান, সেটিতে তিনি হ্যালোটাস্কের মধ্যে দৈনিক ২-৩ ঘণ্টা কাজ করে মাসিক একটা অতিরিক্ত আয় করতে পারবেন।

ডাউলোড লিংক

https://urlzs.com/2aNJu (অ্যানড্রয়েড)
https://apps.apple.com/us/app/hellotask/id1448530002 (আইওএস)
https://hellotask.app/ (ওয়েব ব্রাউজার)

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments