রাজনৈতিক অস্থিরতার মাত্রা যত বাড়বে, অর্থনৈতিক সংকটও তত বাড়বে বলে মতপ্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এ অবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলোকে সহনশীল মনোভাবের অধিকারী হয়ে আলোচনার মাধ্যমে সংকট নিরসনের পরামর্শ দিয়েছেন তারা। সরকার অবশ্য ইতোমধ্যে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় পরিকল্পিত লোডশেডিং করা হচ্ছে। একই সঙ্গে সময় কমানো হয়েছে অফিস-আদালতের। পাশাপাশি ডলার সংকট কমাতে বিলাসী পণ্য আমদানিতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। অতি প্রয়োজনীয় ছাড়া অন্য সব পণ্যের এলসি না খোলার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। এমনকি বেশকিছু উন্নয়ন প্রকল্পে স্থগিত করা হয়েছে অর্থ বরাদ্দ। তবে সরকারের নেওয়া এসব পদক্ষেপের সুফল মূলত নির্ভর করছে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর। রাজনৈতিক সংঘাত বাড়লে উৎপাদন হ্রাস পাবে, তা বলাই বাহুল্য। এতে কাজের ক্ষেত্র যেমন সংকুচিত হবে, তেমনই অর্থনীতিতে তৈরি হবে স্থবিরতা, যা মোটেই কাম্য নয়। করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাবে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই মূল্যস্ফীতির উল্লম্ফন ঘটছে, যা থেকে বাংলাদেশও মুক্ত নয়। বস্তুত দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা সাধারণ মানুষ। সামষ্টিক অর্থনীতিতে এমন অস্থিরতার মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতার লক্ষণগুলোও ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সারা দেশে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, এর মাত্রা বৃদ্ধি পেলে দেশের অর্থনৈতিক সংকটও ঘনীভূত হবে, যা কারও জন্যই মঙ্গলজনক হবে না।
উদ্বেগজনক হলো, আগামী বছরটা নির্বাচনি বছর। নির্বাচনি বছরে এমনিতেই দেশের অর্থনীতিতে এক ধরনের স্থবিরতা তৈরি হয়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, রাজস্ব আদায়সহ বিনিয়োগ কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। গত কয়েক বছরে সরকারি পর্যায়ে বিনিয়োগ বাড়লেও বিদেশিসহ দেশে ব্যক্তি পর্যায়ে বিনিয়োগচিত্র হতাশাজনক। দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, দেশে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ না থাকায় কর্মসংস্থানের ওপর এর প্রভাব পড়ছে, যা প্রবৃদ্ধি অর্জনে নেতিবাচক ধারার সূচনা করেছে। দারিদ্র্য বিমোচনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে দেশি-বিদেশি বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশে আইনের শাসন ও বাণিজ্য সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করাসহ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা অপরিহার্য। একই সঙ্গে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, চাঁদাবাজি, মাস্তানিসহ সব ধরনের হয়রানিমূলক কর্মকাণ্ড কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা গেলে অর্থনীতিতে নতুন প্রাণের সঞ্চার হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে সংঘাত-নৈরাজ্য; অবিশ্বাস ও সন্দেহ দূর করতে আলাপ-আলোচনাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণই শ্রেয়। পরস্পরের মধ্যে বিদ্যমান সমস্যাগুলো যদি আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসা যায় এবং সেখানে সমাধানের পথ খোঁজা হয়, তাহলে দেশের রাজনীতিতে সংঘাত, সংঘর্ষ ও নৈরাজ্য হ্রাস পাবে। রাজনৈতিকভাবে অসহিষ্ণু এ দেশটিতে নির্বাচন, বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে সহিংস পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে কেবল সাধারণ মানুষ নিরাপত্তা ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না; অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম এবং দেশের ব্যবসায়-বাণিজ্য ও বিনিয়োগসহ সরকারের রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাছাড়া সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিভিন্ন উৎপাদনশীল খাত ও রপ্তানিমুখী শিল্প ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ায় এসব শিল্পের ওপর নির্ভরশীল হাজার হাজার শ্রমিকের ভাগ্যও হয়ে পড়বে অনিশ্চিত। সবচেয়ে বড় কথা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম না হলে বিনিয়োগ ও উন্নয়নে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসবে না। এসব বিষয় মাথায় রেখে ন্যায়নিষ্ঠ ও পরিচ্ছন্ন মন-মানসিকতার পরিচয় দিয়ে রাজনৈতিক সংকট নিরসনের উপায় খোঁজা হবে-এটাই প্রত্যাশা।