Saturday, July 27, 2024
spot_img
Homeনির্বাচিত কলামঅমানবিক, অগ্রহণযোগ্য

অমানবিক, অগ্রহণযোগ্য

গত ২১ ডিসেম্বর দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় জানাজা পড়ানোর একটি ছবি ছাপা হয়েছে। একটি পত্রিকায় ছবির ক্যাপশনে লেখা হয়েছে: ‘হাতকড়া ও ডান্ডাবেড়ি নিয়েই মায়ের জানাজায় আলী আজম। গতকাল গাজীপুরের কালিয়াকৈরের পাবরিয়াচালা এলাকায়।’ খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, হাতকড়া ও ডান্ডাবেড়ি পরা অবস্থায় মায়ের জানাজা পড়ালেন আলী আজম। আলী আজম কালিয়াকৈর উপজেলার বোয়ালী ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি। জানা গেছে, কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রা ত্রিমোড় এলাকায় অবস্থিত আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে ২৯ নভেম্বরে হামলার অভিযোগে তাকে ২ ডিসেম্বর গ্রেফতার করা হয়। হাতকড়া ও ডান্ডাবেড়ি পরা অবস্থায় মায়ের জানাজা পড়ানোর ছবিটি যারাই দেখেছেন, তারাই মর্মাহত ও বেদনার্ত হয়েছেন। ক্ষোভে-বিক্ষোভে ফেটে পড়েছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার প্রতিফলন বিধৃত হয়েছে। কারা কর্তৃপক্ষ ও পুলিশের এহেন আচরণকে কেউই সহজভাবে নিতে পারেননি। আইনজ্ঞদের মতে, এটা শুধু অমানবিকই নয়, সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদিন মালিক বলেছেন, ডান্ডা বেড়ি পরিয়ে মায়ের জানাজায় নিয়ে যাওয়া মধ্যযুগে ফিরে যাওয়ার একটি বীভৎস উদাহরণ। অনেকে এমনও বলেছেন, জানাজার সময় অন্তত হাতকড়া ও ডান্ডাবেড়ি খুলে দেয়া যেতো। সেটাও না করে চরম নিষ্ঠুরতার পরিচয় দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, আলী আজমকে প্যারোলে মুক্তি দেয়া নিয়ে নানা টালবাহানা ও সময়ক্ষেপণ করা হয়েছে। তার মা মারা গেছেন রোববার। কিন্তু তার প্যারোলে মুক্তি পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছে মঙ্গলবার পর্যন্ত। এটা আমাদের আইন ও বিচারের ক্ষেত্রে সংবেদনশীলতার বড় রকমের ঘাটতি ছাড়া আর কী বলে অভিহিত করা যায়?
আলী আজম রাজনৈতিক বন্দি। রাজনৈতিক কারণে তাকে আটক ও অন্তরীণ রাখা হয়েছে। তাও তথাকথিত এক ‘গায়েবি’ মামলায়। মামলার বাদী চন্দ্রা ত্রিমোড় এলাকার আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের অফিস সহকারী আবদুল মান্নান শেখ। তিনি এক দৈনিককে বলেছেন, ‘কসম, আমি ঘটনাস্থলে ছিলাম না। এখানে আলাউদ্দিন এসআই ছিল, ওই স্যার আমাকে বার বার ফোন দিয়া অস্থির কইরা ফেলছে। তখন বলছি, স্যার, আমি দাওয়াতে আছি। আমি দাওয়াত থাইক্যা মামলা করলাম কীভাবে। আমি ছিলাম না, দেখিও নাই। স্যার গো, আমি কইছিলাম, স্যার, আমারে আপনারা ঝামেলায় ফালাইয়েন না।’ আবদুল মান্নান শেখের এই বক্তব্য থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না। ‘ঝামেলা’ আসলে লাগিয়েছেন ওই পুলিশ কর্মকর্তা তথা পুলিশ। এ ধরনের গায়েবি মামলার আসামীদের নির্দোষ হওয়াই স্বাভাবিক। এদিকের বিচারের আলী আজম কতটা অপরাধী সহজেই অনুমেয়। অথচ, তার সঙ্গে যে ব্যবহার করা হয়েছে, তার কোনো তুলনা হয় না। তিনি দুর্ধষ নন, সন্ত্রাসী নন, জঙ্গী নন। তিনি দণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদিও নন। তার হাতে হাতকড়া বা পায়ে ডান্ডাবেড়ি পরানোর সুযোগ বা প্রয়োজন কোনোটাই ছিল না। জেল কোডের ৭২১ ধারায় কেবল দুর্ধষ বন্দির আটক নিশ্চিত রাখতে আদালতে পাঠানোর সময় ডান্ডাবেড়ি পরানোর বিধান আছে। এ বিধান কার্যকর করার ক্ষেত্রেও সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া আছে। সেটা কতটা অনুসরণ করা হয়েছে, সে প্রশ্ন উঠতে পারে। স্মরণ করা যেতে পারে, গত ২০ নভেম্বর ঢাকা আদালতের ফটক থেকে দুই জঙ্গীকে বাইরে থাকা তাদের সঙ্গীরা ছিনিয়ে নিয়ে যায়। তাদের খোঁজ পুলিশ এখনো বের করতে পারেনি। ওই দুই জঙ্গীকে হাতকড়া ও ডান্ডাবেড়ি ছাড়াই জেলখানা থেকে আদালতে পাঠানো হয়েছিল। যাদের বিধি মোতাবেক হাতকড়া ও ডান্ডাবেড়ি পরানো উচিত ছিল, তাদের তা পরানো হয়নি। আর যার হাতকড়া ও ডান্ডাবেড়ি পরানো বিধিসম্মত ছিল না, তাকে তা পরানো হয়েছে। মায়ের মৃত্যু ও জানাজাকে পর্যন্ত বিবেচনায় আনা হয়নি। আইন-বিধির এটা যে চরম অপপ্রয়োগ তাতে সন্দেহ নেই।
আইনবিধ ও বিশেষজ্ঞদের মতে, আলী আজমের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে তা গর্হিতই নয়, মানবিকতার মারাত্মক ব্যত্যয়। তার মানবাধিকার উপেক্ষিত ও লঙ্ঘিত হয়েছে। এর দায় জেল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ এড়িয়ে যেতে পারে না। আমরা লক্ষ করে আসছি, পুলিশের একটি অংশ, আগ বাড়িয়ে সরকারের প্রতি অতি আনুগত্য দেখিয়ে আইন অমান্য ও উপেক্ষা করছে। আইনের বিধিবিধান লঙ্ঘন করছে। এতে জনগণের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে এবং দায়দায়িত্ব গিয়ে বর্তাচ্ছে সরকারের ওপর। সামগ্রিকভাবে পুলিশের সফলতা যেমন আছে, তেমনি ব্যর্থতাও আছে। তবে প্রতি তুলনায় ব্যর্থতার ভাগই বেশি বলে সবার ধারণা। আলোড়ন সৃষ্টি করা বহু ঘটনা বা হত্যাকাণ্ডের এখনো কোনো কিনারা করতে পারেনি পুলিশ। বুয়েটের শিক্ষার্থী ফারদিনের মৃত্যুরহস্য মাসাধিককালেও উদ্ঘাটিত হয়নি। তৌকির হত্যা, সাগর-রুনি হত্যাসহ অনেক মামলার তদন্ত পর্যন্ত শেষ হয়নি। বিচার তো আরো পরের কথা। পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। পুলিশের দলীয় রাজনীতির প্রতি আনুগত্য, অপকর্ম-অপরাধের প্রতি অতিরেক ঝোঁক, অনিয়ম-দুর্নীতি ইত্যাদি সর্বত্র আলোচনার বিষয়। সরকারকে পুলিশের রাস টেনে ধরতে হবে নিজের স্বার্থেই। আলী আজমের ঘটনা যেভাবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে তাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অজানা থাকবে না বা নেই। এটা দেশের আইন, রাষ্ট্রব্যবস্থা, মানবিক মূল্যবোধের চর্চা প্রভৃতি সম্পর্কে ভুল বার্তা দেবে। কাজেই, এই ঘটনার অনুপুঙ্খ তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনী ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments