Wednesday, October 4, 2023
spot_img
Homeসাহিত্যঅভিবাসনের সুখ-বিড়ম্বনা! 

অভিবাসনের সুখ-বিড়ম্বনা! 

সময়ের কর্মসূচি সময়ে শুরু হয়, এটি দেখে আমরা মোটেও অভ্যস্ত নই। অফিস সময় ৮টায় হলে যেমন আমাদের অফিস পৌঁছতে দেরি হয়, আবার ১০টা হলেও একই দশা হয়। দুটোর মিটিং দুটো বাজেই শুরু করা আমার দেশে স্বাভাবিক ঘটনা নয়। অগত্যা কোন দুর্বিপাকে প্রশ্নের মুখে পড়লে অনুযোগ-অজুহাতের তো কোনো ঘাটতিই নেই। কখনো যানজট, কখনো অপ্রত্যাশিত কারণে যানবাহন নাই, এমন নানা বাহানার তো কোন অভাব নেই। এভাবে যুগ যুগ কাটিয়ে, নিয়ম নীতির দেশে এসে সময়ের সাথে পাল্লা দেয়া নিতান্তই কঠিন। এ দেশে কাজের ধরন ভেদে,  বিনা এপয়েন্টমেন্টে অফিস, আদালত, হাসপাতালে প্রয়োজনীয় কাজে সংশ্লিষ্টদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ এর সুযোগ যেমন আছে আবার পূর্ব থেকে এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে দেখা-সাক্ষাৎ এর বিধান ও আছে। তবে সর্ব ক্ষেত্রেই জরুরি প্রয়োজন ব্যতিরেকে এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে দেখা সাক্ষাতকেই উৎসাহিত করা হয়। 

এ দেশে দর্শনার্থীদের বেশ সম্মানের সাথে দেখা হয়। তাই কাজের রকমফেরে, এপয়েন্টমেন্ট এর সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়। দায়িত্ব প্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ( কর্মকর্তা শব্দটির পরিবর্তে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নাম ব্যবহৃত হয়) দর্শনার্থীকে সন্তুষ্ট করতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যান। মনে হয় সেবা গ্রহীতার সন্তুষ্টির উপরই চাকরির ভাগ্য নির্ভরশীল, সেটি কোন সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হোক আর ব্যবসা, বানিজ্যের প্রতিষ্ঠান ই হোক। গ্রাহক সেবায় এখানে কার্পণ্যের কোন সুযোগ নেই। কোন সেবা গ্রহীতা অনিবার্য কারণ ছাড়া এপয়েন্টমেন্ট এ গড় হাজির হলে বিষয়টি তাদের খুব অপছন্দ হয়।  কাকুতি মিনতি আর তদ্বিরের কোন সুযোগ এখানে নেই। ছেলের ভ্যাক্সিনেশন এর এপয়েন্টমেন্টে গড় হাজির হওয়া থেকে বিষয়টি অনুধাবনের সুযোগ হলো।

আগের পর্বে দুটো অতি গুরুত্বপূর্ণ দলিল নিয়ে আলোচনা করেছিলাম, যার একটি সিন (SIN) কার্ড আর অপরটি হেলথ কার্ড। এ দেশে হেলথ্ কার্ডধারী প্রত্যেকেই ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান বা পারিবারিক চিকিৎসক পাওয়ার অধিকার রাখেন। এক্ষেত্রে ব্যাক্তি তার পছন্দ অনুযায়ী ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান হিসেবে যে কোন লাইসেন্সধারী প্রফেশনাল চিকিৎসককে বেছে নিতে পারেন।  তবে চিকিৎসকরা একটা নির্ধারিত সংখ্যার বেশি মানুষের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান হতে পারেন না। তাই পছন্দসই চিকিৎসকের কোটা না থাকলে পরবর্তী পছন্দক্রমে যেতে হয়। তবে প্রত্যেক ফিজিশিয়ান বা চিকিৎসক-ই স্বাস্থ্য বিভাগ কর্তৃক আরোপিত বিধিমালা কে কঠোরভাবে অনুসরণ করেন। ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান তার অফিসে রেজিষ্ট্রিকৃত সকল রোগীর স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য উপাত্ত সংরক্ষণ করেন। তবে যে কোন স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যায় পারিবারিক চিকিৎসকের কাছেই যেতে হবে বিষয়টি মোটেও এমন নয়।

এ দেশে প্রতিটি কমিউনিটিতেই ওয়াক-ইন ক্লিনিক থাকে। এসব ক্লিনিকগুলো অনেকটা ছোট আকারের হাসপাতালের মতো। আকার ও কমিনিউনিটি ভেদে কোথাও চার পাঁচজন আবার কোথাও দশ/বারোজন চিকিৎসকও দায়িত্ব পালন করেন। এ সমস্ত ক্লিনিকগুলো প্রাইভেট ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হলেও হেলথ্ কার্ডধারী কোন সেবাগ্রহীতাকে সেখানে কোন অর্থ পরিশোধ করতে হয় না। অভিজ্ঞতা সম্পন্ন লাইসেন্স প্রাপ্ত চিকিৎসকরা নিয়মিত রোগী দেখে চিকিৎসা দেন, প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নীরিক্ষার জন্য বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার বা ল্যাবে পাঠান, প্রয়োজন মনে করলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে রেফার করেন। মজার ব্যাপার হলো, এই পুরো প্রক্রিয়াটিতেই ধনী, গরিব নির্বিশেষে কাউকেই কোন অর্থ পরিশোধ করতে হয় না।

প্রশ্ন থেকে যায়, তাহলে প্রাইভেট ব্যবস্থাপনার এ সমস্ত হেলথ সেন্টার বা ক্লিনিকে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য সেবায় নিয়োজিত কর্মীদের বেতন ভাতা ও ব্যবস্থাপনা ব্যয় নির্বাহের উপায় কি? প্রভিন্সিয়াল সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের বিধিবিধান অনুযায়ী  পার্টনারশিপ চুক্তিতে প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এ সমস্ত সেবা কেন্দ্রগুলো পরিচালিত হয়। হেলথ্ কার্ডধারী প্রত্যেকেই মূলত সরকারের হেলথ ইন্স্যুরেন্স কর্মসুচির আওতাভুক্ত। কল্যাণমুখী এই বিমা কর্মসূচির আওতায় হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, বিভিন্ন রকম স্বাস্থ্য পরীক্ষার ল্যাবে সেবাগ্রহীতা জনগণকে কোন অর্থ পরিশোধ করতে হয় না, প্রতিটি প্রভিন্সিয়াল সরকার তাদের বার্ষিক বাজেটের মাধ্যমে এ সমস্ত সেবা কর্মসূচির ব্যয় নির্বাহ করেন। 

আমাদের দেশে অর্থ, বিত্ত, ক্ষমতা অনুযায়ী যেমন দেশ সেরা চিকিৎসকের সেবা নেয়ার সুযোগ আছে, এ দেশে এ পদ্ধতিটি একেবারেই অনুপস্থিত। যে যত পদধারী ক্ষমতাবান-ই হোক না কেন, ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান বা ওয়াক-ইন ক্লিনিকে দায়িত্বরত চিকিৎসকের রেফারেন্স ছাড়া বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার সুযোগ নেই। তবে যে কোন ইমারজেন্সি সিচুয়েশনে, হাসপাতালে ভর্তি হলে, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা সবকিছুই তত্ত্বাবধান করেন। এক্ষেত্রেও ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান কে রোগীর বিস্তারিত তথ্য অবহিত করা হয়। উত্তর আমেরিকার দেশ কানাডায়,  প্রত্যেক নাগরিকের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্যকে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত গোপনীয় তথ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই অনুমতি প্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগন ব্যতিত অন্য কোন তৃতীয় পক্ষ এ সমস্ত স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

নতুন অভিবাসী হিসেবে, ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানের গুরুত্বকে অনুধাবন করে দ্রুতই একজন ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান ঠিক করতে তথ্য সংগ্রহে নেমে পড়ি। ভাষা, কৃষ্টি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক বিবেচনায় নিয়ে একজন বাংলাভাষী চিকিৎসক প্রাধিকার বিবেচনায় থাকলেও, কেলগরি শহরে ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানদের তালিকায় কোন বাংলাভাষী কে না পেয়ে ভারতীয় বংশোদ্ভূত অপেক্ষাকৃত সিনিয়র চিকিৎসক ডাক্তার সুরিনদার কর উবি কে ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান হিসেবে ঠিক করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। বাসার অনতিদূরে হাঁটার দুরত্বে পাইনরিজ মেডিকেল সেন্টার, যেটি ডক্টর উবির ক্লিনিক নামেই সমধিক পরিচিত। ফোন ডিরেক্টরি থেকে তথ্য নিয়ে ফোন করে উদ্দেশ্য বর্ণনা করতেই, অপর প্রান্ত থেকে মেডিকেল অফিস সহকারী পরদিন সকাল ১০টায় হেলথ্ কার্ডসহ দুটি আইডি নিয়ে স্ত্রী-সন্তানসহ যেতে বললেন।

৩০ জুন ২০০৬, সকাল ১০টার অব্যবহিত পূর্বেই হাজির হই পাইনরিজ হেলথ্ সেন্টারে। অভ্যর্থনা কক্ষে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টসগুলো জমা দিলে, রিসেপশনিস্ট ওয়েটিং লাউঞ্জে অপেক্ষা করতে বললেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ভিতর থেকে বেরিয়ে আসেন ডক্টর সুরিনদার কর উবি। নাম ধরে ডাকতেই, এগিয়ে গেলে পরিবার সমেত উনাকে ফলো করতে অনুরোধ করলেন। প্রথম দর্শনে মনে হলো, বয়স ষাটের কাছাকাছি। আমার দেশের ডাক্তারদের মতো ভাব গাম্ভীর্য আর তাড়াহুড়ো নেই, তবে বেশভূষায় বাঙালীয়ানা আছে, যদিও তিনি ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের শিখ সম্প্রদায়ের মানুষ। পরিচয় আর কুশল বিনিময়ের পর এক এক করে আমাদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু করলেন। সর্বশেষ মেডিকেল চেকআপ, জটিল কোন স্বাস্থ্যগত সমস্যা, নিয়মিত কোন ওষুধ সেবন, পারিবারিক কোন জটিল রোগ ব্যাধির ইতিহাসসহ আরও কত কী! তারপর শুরু করলেন নানাবিধ চেকআপ।

রক্তচাপ, ওজন, উচ্চতা আর সংগে রোগ-শোকের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে পূর্ণ শারিরীক পরীক্ষা-নিরীক্ষার নিমিত্তে প্রত্যেকের জন্য রেফারেন্সসহ একটি ফর্দ তুলে দিলেন। এসব পরীক্ষা নীরিক্ষার জন্য কোন ডায়াগনস্টিক সেন্টার বা ল্যাবে যেতে হবে, কিভাবে এপয়েন্টমেন্ট করতে হবে সেটিও বুঝিয়ে দিলেন। এসব কাজে আমাদের কোন অর্থ পরিশোধ করতে হবে না, সেটি বলতেও ভুল করেননি। কোন তাড়াহুড়ো নেই, হম্বিতম্বি নেই, মনে হলো আমাদের শরীর স্বাস্থ্যের দায়িত্বভার তুলে নিয়ে তিনি যেন এক অন্যরকম অভিভাবক হয়ে উঠলেন। নতুন অভিবাসী হিসেবে কাজ কর্মসহ কোন রকম সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি কিনা, সে-সব বিষয় নিয়েও কথা বললেন। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ভিন্নতার কারণে সৃষ্ট সমস্যাগুলো সাময়িক, দ্রুতই তা কেটে যাবে বলে আশাবাদও ব্যক্ত করলেন। 

ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান শব্দটির সাথে পরিচিত হলেও এর বাস্তবতাকে পর্যবেক্ষণ করে এক রকম মানসিক প্রশান্তির জন্ম নিল। তবে নতুন চাকুরির সাথে মানসিক প্রশান্তির অমিলে দগ্ধ হচ্ছি প্রতিনিয়ত, সেই সাথে আবহাওয়ার বিমাতা সূলভ আচরণে নিজেকে মানিয়ে নেয়া বড় বেশি চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠছে। মানুষের মনের মতোই কেলগেরিতে আকাশের রং বদলায়। সকালের রৌদ্রময় উষ্ণ প্রকৃতি দুপুরের আগেই হিমাংকের বিপরীতে চলে যায়, ঘড়িতে ঘণ্টার কাটা না ঘুরতেই আবারো তাপদাহ শুরু হয়। প্রকৃতি আর পরিবেশের এমন এলোমেলো আচরণে ক্রমান্বয়েই যেন বেসামাল হয়ে উঠছি। 

চাকরির আজ তৃতীয় দিন। ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানের অফিসে প্রয়োজনীয় কাজ শেষে দ্রুতই রওনা হলাম কর্মস্থলের উদ্দেশে। যাতায়াতে কেলগেরি ট্রানজিটের বাস ট্রেনই আমার ভরসা। আজ যানবাহনে সব সহযাত্রীদের মধ্যে এক গভীর মিল খোঁজে পেলাম। প্রায় সবার কাছেই একটি ব্যাকপ্যাক বা ছোট আকারের ব্যাগ! কারওটা কাঁধে ঝুলানো, কারো বা পিঠে, কেউ বা হাতে বহন করছে। গত দুই দিনও দেখেছি, তবে এতটা গভীর অন্তদৃষ্টিতে নয়। ব্যাগ বহনের এ দৃশ্যটি বড়ই রহস্যময় লাগছে!!

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments