গ্রাম বাংলার অবারিত মাঠ। কৃষক, দিন মজুর, খেটে খাওয়া অসংখ্য মানব-মানবী। প্রতিদিন প্রকৃতির বেলাভূমিতে। কাকের ডাক মোরগের ডাক শুরুর আগেই ঘুম থেকে জেগে উঠে। পেটভরে একবেলা খেতে পারে না। প্রতিদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেও তাদের ভাগ্যে জোটে না বউ বাচ্চাদের নিয়ে এক বেলা মনের মতো খাবার। দিনের পারিশ্রমিক হাতে নিয়ে চাল ডাল কেনার পর গোশত খাওয়া বহু দূরের কথা। মাছ, মসলা কেনার টাকা থাকে না। রাতে বাড়ি ফেরে হেঁটে হেঁটে কয়েক মাইল। পুরো দিন ১২ (বার) ঘন্টা অক্লান্ত পরিশ্রম করে দেহ দূর্বল। বিকেলে আহারেরও জোগাড় হচ্ছে না। ভাগ্যকে নীরবে দোষারোপ করে দীর্ঘপথ হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরে। কঠোর পরিশ্রমে হাঁটতে শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে না , তবুও হেঁটে চলে। ভাগ্যকে দোষারোপ করে না, ভাগ্যের স্বাদ পায়নি। তাই অভিযোগ নেই লম্বা একটি দীর্ঘশ্বাসই তাদের একান্ত সাথী।
তারা দেখে চলারপথে কিশোর, তরুণ, যুবক, কিংবা সচেতন মহল গ্রামে-গঞ্জে, পাড়া-মহল্লায়, শহরে বয়স্কদের অথবা পরিচিত-অপরিচিত মুসলমানদেরকে দেখামাত্র সালাম দেয়। তাদের মতো অভাগাদের কেউ সালাম, শ্রদ্ধা করে না। তারা সালাম দিলেও তাদের সালামের সঠিক জবাবও অনেকে দেয় না। এমনকি তাদের দিকে তাকাও না। যেন ওরা মানুষই নয়। যদিও সমাজের বিত্তশালী বিত্তবানরা একে অপরের সালামের জবাবসহ পুরো পরিবার সদস্যদের খবরাখবর জেনে নেয়। এভাবেই চিরাচরিত প্রক্রিয়ায় চলে আসছে আমাদের সমাজের চলাফেরা। গরীবরা সবখানেই অবহেলিত। অনেকটা অছ্্ুযত।
মনে আসলো আমাদের এলাকার হাজারো দিনমজুরের মধ্যে দু’ভাই দুই দিনমজুরের হররোজ চলাচলের কাহিনী। কঠোর পরিশ্রমী ছিল তারা। একজনের নাম ছিল ওডু অপরজনের মুবই। দেশে এই ধরনের লক্ষ-কোটি দিন মজুরের বাস। এরা ছড়িয়ে আছে প্রত্যেক এলাকায়। জীবন বাঁচানোর লড়াইয়ের মধ্যে দিয়েই তাদের জীবন।
নিঝুম রাতের কোলাহল আড্ডায়, ঝলমল ডিসকো ক্লাবে তালে তালে নৃত্যে যখন পুঁজিবাদীরা হেলিয়ে দুলিয়ে অচেনা অজানা পাপিয়াদের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ছে নেশায়। তখন অডু ও মুবই এবং তাদের মতো লক্ষ লক্ষ দিনমজুর ও তাদের বউ-বাচ্চরা পেটের ক্ষুধায় ছটফট করে। বাচ্চারা কেঁদে কেঁদে বলছে কিছু খেতে দে মা। ওরা বাচ্চাদের সান্ত¡না দেয়, দেয়ার মতো কিছুই নেই। মা কাঁদতে থাকে নীরবে। পরিশ্রান্ত বাবা খালি পেটেই অঘোরে ঘুমান। ক্ষুধার ধকল অনুভব করে না।
চলে আসি মূলপর্বে। অডু পেশাদার রিকশা চালক। মুবই পেশায় দিনমজুর। গোলাপগঞ্জ রনকেলিতে তাদের আবাস। গোলাপগঞ্জ চৌমুহনী তাদের দৈনিক আয়ের উৎস। সত্তরের দশকে এলাকার রাস্তা চলাচলের দুরুহতা ছিল সর্বত্র। রাস্তার তেমন উন্নয়ন নজরে পড়তো না। ভাঙ্গা সড়ক দিয়ে যাতায়াত করতে হতো। গ্রামের রাস্তার পরিধির স্বল্পতা সরু হবার কারণে রিকশা চালক নিজ হাতে টেনে নিয়ে যেতো। এটাই ছিল সে সময়ের বাস্তবতা। রিকশা দিয়ে যারা নিয়মিত যাতায়াত করতেন তারা অডুর রিকশা দিয়ে যাতায়াত পছন্দ করতেন। দীর্ঘ ৩-৪ মাইল পথের চালক অডু হলে খোশগল্প, রসের গল্পের মধ্যে দিয়ে উপভোগে অডুর রিকশার যাত্রী হিসাবে অনেকের পছন্দ ছিল। অত্যন্ত সহজ সরল স্বভাবের অডুর জ্বিহবা একটু সম্ভবত খাটো বিধায় শব্দ উচ্চারিত হতো ভিন্নভাবে। শব্দে ও ছন্দে রসের কথাগুলো শুনতে যাত্রী তার সাথে অহেতুক আলাপে জড়াত। অডু’র রিকশার যাত্রীদের ভাড়া কোন চৌধুরী হলে এক টাকা, অন্য কেউ হলে আটআনা। এটাই হর-হামেশা দাবি ছিল অডু’র। কেন এমন ফারাক তা কেউই তথ্য সংগ্রহ করেনি। অনেক সময় দু’জনের অধিক যাত্রী নিয়ে, পায়ের প্যাডেলে চাপ দিতে দিতে পৌঁছে দেয়া হতো যাত্রীদের দূর বহুদূর। রোদের প্রখরতা, ঝড়-বৃষ্টি-বাদল রিকশা চালকের মাথার উপর দিয়েই যায়।
তার মতো হাজার হাজার রিকশা চালক পেটের ক্ষুধা নিবারণে, পরিবারকে বাঁচাতে যাত্রীদেরকে নিয়ে যায় নিয়ে আসে। মরণ অবদি তারা সেবা দিয়ে যাচ্ছে। বিনিময়ে তাদেরকে কিছু পয়সা দেয়া হলেও তাদেরকে অবহেলা ও ঘৃণার চোখে দেখা একান্তভাবেই অমানবিক ও মর্মান্তিক।
২০১৫ সালে সংক্ষিপ্ত সফরে দেশে অবস্থানকালে বিকালে গোলাপগঞ্জ চৌমুহনীতে হাঁটতে দেখি একটি যুবক রিকশা চালককে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে এক পর্যায়ে রিকশা চালকের গালে থাপ্পড় দেয়। বিবেকের সাথে আপোষ করতে পারিনি, ছুটে এসে যুবককে অসহায় রিকশা চালকের থাপ্পড়ের উপযুক্ত জবাব আমি দিয়েছি। রিকশা চালকের হাতে এক হাজার টাকা দিয়ে তাকে বললাম ডাল, চাল, মাছ এ টাকায় যা হয় তা নিয়ে আজ বাড়িতে যাও। লক্ষ্য করলাম, আমাকে কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে সে। আমি ভাবলাম, সমাজে বাচ্চাদের পরিবার থেকে সঠিক সংস্কার দেওয়া হচ্ছে না। বাচ্চাদের আদব কায়দা, বড়দের সম্মান করা শেখানোর দায়িত্ব মা-বাবার। শেখাতে হবে- সম্মানের পাত্র সবাই, সে যেই হউক, ড্রাইভার, বাড়ির কাজের লোক, কৃষক, অথবা ভিখারি। অর্থাৎ সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে সম্মান ও ভালবাসা দিলে সমাজ, দেশ, জাতি উপকৃত হবে।
অডুর ভাই মুবই ভিন্ন ধরনের দিনমজুর। সত্তরের দশকে গোলাপগঞ্জে চা নাস্তা, মিষ্টি, জিলাপি, আমিত্তির ঝলমল নামী-দামী রেস্তোরাঁর মালিক ছিলেন দুইভাই তোতা মিয়া ও পাখি মিয়া। ছোট বড় অনেকেরই জম্পেশ আড্ডার কোলাহলের রেস্তোঁরা সেটি। বিবাহ সম্পর্কিত যাবতীয় মিষ্টি এখান থেকেই সংগ্রহ করা হতো। মুবই সেখানেই অপেক্ষায় থাকতো হয়তো তাকে কারো প্রয়োজন হবে। ওই যুগে অনেকাংশে জামাই পালকি চড়ে যেতেন এবং বউকে একই পালকিতে নিয়ে আসা হতো। প্রতিদিন কেউ না কেউ বিবাহের মিষ্টি নিতে আসলে তোতা মিয়া বর পক্ষকে তাদের অনুষ্ঠানের কাজে মুবইকে নেয়ার পরামর্শ দিতেন। এভাবে হাজার হাজার বর কন্যাকে নিজ কাঁধে তুলে পৌঁছে দিয়েছেন।
তাদের কি কারো স্মরণে আসে অডু’র কথা। বাস্তবতা মোটেই না। কারণ ওরা যে অডু মুবই। তাদেরকে সামান্য পয়সা তো দেয়া হয়েছে। পয়সা দিয়ে সেবা কেনা হয়েছে। তাদের কষ্টের কথা মনে রখেতে হবে কেন? তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি ওদের জীবন নিয়ে লিখব। লিখছি একটি উপন্যাস। সে উপন্যাসের পাতায় লিখে দিবো সবার সাথে অডু ও মুবই’র নাম। তাদের কষ্টের কথা। তাদের মানবেতর জীবনের কথা।